মফস্বলের ছেলে বাবাই তেমনভাবে কখনো কলকাতাকে চিনে উঠতে পারেনি। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে কলকাতার কয়েকটি বিশেষ স্মৃতি মনে পড়ে—চিড়িয়াখানা দেখা, আমিনিয়ায় প্রথমবার বিরিয়ানি খাওয়া, ধর্মতলায় শহীদ মিনার দেখা, আর টুংটাং করে ধীরে ধীরে চলা সেই ট্রাম। কিন্তু এর বাইরে কোনোদিন সময় করে কলকাতাকে আর ঘুরে দেখা হয়নি, শহরটাকে কাছ থেকে চেনা হয়নি।
অন্য রাজ্যে কর্মসূত্রে যখন কেউ জিজ্ঞেস করেছে, বাবাই সবসময় বলেছে, “আমার বাড়ি কলকাতা”, কারণ বারাসাত বললে তো কেউ চিনবে না। এখন তো meme বেরিয়েছে এটা নিয়ে, তাই আজকাল সে বলে, “পশ্চিমবঙ্গ।”
কলকাতা আজও বাবাইয়ের কাছে একটা গোলকধাঁধার মতো। এই মধ্যবয়সেও একা কলকাতায় গেলে গুগল ম্যাপ ভরসা। খুব প্রয়োজন না হলে মানুষকে কিছু জিজ্ঞেস করে না। আসলে, জিজ্ঞেস না করারও একটা কারণ আছে—কলকাতায় তো বাঙালি থাকেই না এখন, সবাই অবাঙালি, অনেকেই বাংলায় কথা বলে না।
কয়েক মাস ধরে বাবাই ভাবছিল, পুচুকে নিয়ে একদিন কলেজ স্ট্রিট যাবে। কিছু বই কিনবে, আর ট্রামে চেপে কলকাতা ঘুরবে। বাবাই তো তার কলেজ জীবন কলকাতায় কাটায়নি। কিন্তু অনেককে দেখেছে, কলকাতায় কলেজ জীবন কাটাতে, প্রিয় মানুষের হাত ধরে কলেজ স্ট্রিটে হাঁটতে, কফি হাউসে বসে গল্প করতে, প্রেম করতে। সেই ইচ্ছার জেরেই তার মনে হয়েছিল, এই মধ্যবয়সে এসে যদি সেই না-বাঁচা জীবনটা আবারও সৃষ্টি করা যায়, তবে খুব মজা হবে।
পুচুও তার এই ইচ্ছায় সম্মতি দিয়েছিল। কিন্তু সময় আর হয়ে উঠলো না। কাজের ব্যস্ততায় দিনের পর দিন কেটে গেল। হঠাৎ একদিন অফিসের কাজের ফাঁকে ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে দেখলো—২৪.৯.২৪, সেদিন নাকি কলকাতায় ট্রামের শেষ দিন। বাবাইয়ের বুকটা ধড়াস করে উঠলো। তার একটা ছোট্ট ইচ্ছে, একটা স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।
বাবাই তৎক্ষণাৎ WhatsApp-এ পুচুকে সেই পোস্টটা শেয়ার করলো, সঙ্গে একটা দুঃখের ইমোজি। উত্তরে পুচুও আরেকটা দুঃখের প্রতিক্রিয়া দিলো।
তাহলে, কলকাতায় এক যুগের অবসান ঘটলো। আর বাবাইয়ের একটা ছোট্ট ইচ্ছে অপূর্ণই থেকে গেলো। কেউ জানবে না, কারও কিছু যায় আসবে না। শুধু বাবাইয়ের বুকের ভেতরে একটা চাপা কষ্ট রয়ে গেলো। আমরা সবাই উন্নতির দিকে দৌড়াচ্ছি, সারা শহরই দৌড়াচ্ছে। ট্রাম তো সত্যিই ধীরে চলতো… বড্ডো ধীরে।
একসাথে সমুদ্র দেখা বাকী,
একসাথে পাহাড়, ঝর্ণা দেখা বাকী,
একসাথে শীতের কুয়াশা দেখা বাকী,
নদীর তীরে বসে গোধূলি সময় কাটানো বাকী,
একসাথে বৃষ্টিতে ভেজা বাকী,
একসাথে বৃষ্টির আগ মুহূর্ত দেখা বাকী,
পায়ে নূপুর পরানো বাকী,
একসাথে রাস্তার দোকানে বসে চা খাওয়া বাকী,
পায়ে আলতা পরানো বাকী,
খোঁপায় পলাশ ফুল গুঁজে দেওয়া বাকী,
শাড়ির আঁচলে পাঞ্জাবির রঙ মিলানো বাকী,
একসাথে নৌকায় জলতরঙ্গ খেলা বাকী,
ট্রামে চড়ে কলকাতা ভ্রমণ বাকী।
আমার অনেক দিনের ইচ্ছে একটি প্রেমের গল্পের সিরিজ লেখার। সময় ও সুযোগের অভাবে হয়ে ওঠেনি। আজ এই মধ্যবয়সে এসে সেই পুরোনো ইচ্ছে পূরণ করা শুরু করলাম। গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে কোনো মিল খুঁজে পেলে সেটি শুধুমাত্র কাকতালীয়।
আগেও কয়েকটা ছোট গল্প লিখেছিলাম এই দুই চরিত্র নিয়ে। সেগুলো কোথায় হারিয়ে ফেলেছি জানি না। আজ এই ছোট গল্পকে প্রথম ধরে নিয়ে শুরু করলাম। ধারাবাহিকভাবে চলবে।
কলমে: হিউম্যানিয়া সঞ্জয় (জয়)