রাগ আর অভিমানের মাঝের সূক্ষ্ম ব্যবধানটা বোঝে না সে। নিজেও বুঝতে পারে না—সে কি রেগে গেছে, নাকি অভিমান করেছে। ছোটবেলা থেকেই এসব ছোট ছোট সমস্যায় জর্জরিত। কোনটা রাগ, কোনটা অভিমান, কোনটা আবেগ, কোনটা ভালোবাসা, কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা—সব গুলিয়ে ফেলে।

মানুষের মুখের কথা সে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। হয়তো সেই কারণেই সে বোকা। কিংবা, বোকা বলেই সবকিছু বিশ্বাস করে ফেলে।

গত রাতে পুচুর সঙ্গে খুব ঝগড়া হয়েছে তার। কী নিয়ে হয়েছে—সে নিজেই জানে না। সেটা রাগ? নাকি অভিমান? না কি ভালোবাসার একটু বেশি পাওয়ার যন্ত্রণা? জানে না।

সকালে বাবী ক্ষমা চেয়েছে। রাতে পুচুর সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছে—মনে মনে খুব অনুতপ্ত। সকালে দেখা করে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে—পুচু ছাড়া বাবীর আর কোনো গতি নেই। সে অচল।

বিকেল হতেই বাবী অস্থির হয়ে পড়ে, পুচুকে এক ঝলক দেখার জন্য। যত দূরেই থাকুক, একটা চুম্বকীয় টান অনুভব করে সে।

হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে:

বাবী: আজ একটু দেখা করবি, পুচু?

পুচু: আজ থাক, অন্য দিন।

বাবী: প্লিজ আয় না একটু, ২ মিনিট থাকবি, তারপর চলে যাস!

পুচু: বলছি তো, আজ না।

বাবী: শোন না, একটু আয়! প্লিজ।

পুচু: কেন এমন ঘ্যানঘ্যান করিস?

বাবী: সোনাই রে, আর না একটু, প্লিজ। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

পুচু: কথা দিতে পারছি না, চেষ্টা করবো।

বাবী জানে, এই কথার মানে—সে আসবেই। মনে প্রফুল্লতা ফুটে ওঠে। খুশি খুশি মন।

মন ঠিক করে ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাশে অটোস্ট্যান্ডের কাছে যে রজনীগন্ধা বিক্রি হয়, সেখান থেকে একগোছা কিনে নেবে পুচুর জন্য। ইচ্ছে ছিল, সঙ্গে একটা প্রেমের উপন্যাসও কিনবে, যদি পায়।

কিন্তু উপরে মিটিমিটি হাসছেন সৃষ্টিকর্তা। মানুষ যতই পরিকল্পনা করুক, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটি পাতাও নড়ে না।

বিকেলে শুরু হয় প্রবল ঝড়-বৃষ্টি। চারপাশে এক তাণ্ডব শুরু হয়।

এখানে বলে রাখা ভালো—বাবীর একটা বদঅভ্যাস আছে। যখনই পুচুর জন্য মন কেমন করে, তখনই হোয়াটসঅ্যাপে শুধু লিখে যায়—Puchuuuu Puchuuuu।

এই ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করেও বাবী WhatsApp-এ বারবার লিখে যায়—Puchuuuu Puchuuuu।

কিন্তু নীল টিক আসে না।

আবার কয়েক মিনিট পর লেখে—তবুও নীল টিক আসে না।

বাবী আজ যেকরেই হোক দেখা করবেই। ঝড়, বৃষ্টি, তুফান—কিছুই তাকে আটকাতে পারেনি। বাইক নিয়ে পৌঁছে যায় ফুলের দোকানে। কিনে একগোছা রজনীগন্ধা, সঙ্গে একটা লাল গোলাপ।

বাইক ছুটে চলে গন্তব্যের দিকে। এমন বৃষ্টিতে বই কেনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ভাবলো—এই রজনীগন্ধাই পুচুর মন গলিয়ে দেবে। এটা ভেবেই হেসে ফেললো একটু।

এখন শুধু অপেক্ষার পালা। বৃষ্টি পড়ছে নিরবিচারে। বুকের কাছে ফুলগুলো আগলে রেখেছে, যাতে ভিজে না যায়।

বৃষ্টি থেমেছে। মানুষ রাস্তায় ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু অন্য দিনের মত আজকে জমজমাট নয়—একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কয়েকটি প্রেমিক যুগল ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে গল্প করছে।

অপেক্ষা… অপেক্ষা… অপেক্ষা…

আবার WhatsApp-এ টেক্সট করলো—তবুও নীল টিক এলো না।

বাবী হেরে গেলো প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতি দাঁত বার করে যেন শব্দহীন অট্টহাসি হাসছে।

যত্ন করে বুকের কাছে রাখা রজনীগন্ধাগুলো এভাবে নষ্ট হতে দিতে পারে না সে। অসম্ভব।

সাধারণত বাবী মুখচোরা, কিন্তু আজ এক অন্যরকম সাহস জন্মেছে তার মধ্যে।

একটা স্কুটিতে এক ছেলে আর মেয়ে মাঠের পাশে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে খুনসুটি করছে। বোঝাই যায়, ওরা প্রেম করছে।

বাবী এগিয়ে গেলো ছেলেটির দিকে। খুব বিনীতভাবে বল-

“একটা কথা বলবো?”

ছেলেটি অবাক হয়ে কিছুটা সংশয় নিয়ে তাকিয়ে বলল—

“বলুন।”

বাবী বলল:

“আমি এই একগোছা রজনীগন্ধা এনেছিলাম আমার ভালোবাসার মানুষের জন্য। কিন্তু এই বৃষ্টির জন্য সে আসতে পারেনি। আপনাকে কোনো টাকা দিতে হবে না। আপনি যদি এই ফুলটা আপনার ভালোবাসার মানুষটিকে দেন, তবে এই ফুলগুলোর একটা সঠিক ব্যবহার হবে।”

এই বলে দু’হাতে ফুলগুলো ছেলেটির সামনে তুলে ধরলো।

ছেলেটির মুখের দিকে বাবী তাকাতে পারল না, কারণ তার নিজের চোখেই তখন নেমেছে বৃষ্টি। ঝাপসা চোখে দেখলো—ছেলেটির হাত রজনীগন্ধার গোছাটা নিলো।

এক মুহূর্তে বাবী বাইক নিয়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলো।

আকাশে আর বৃষ্টি নেই, তবুও কয়েক ফোঁটা জল পড়লো তার বর্শতিতে।

রাতে পুচু ফোন করেছিল, কথা হয়েছে। বৃষ্টির কারণে আসতে পারেনি। আগামী দিনে দেখা করবে। ফোনে কথা বলতে বলতে বাবী অনুভব করলো, পুচু নিজেও বেশ কষ্ট পেয়েছে। তারও মন খারাপ।

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *