গল্পের প্রথম পর্ব ::
বারাসাতের গলাকাটা বাড়ি: এক রহস্যময় অভিজ্ঞতা
কলকাতা থেকে খুব বেশি দূরে নয়, উত্তর ২৪ পরগনার বারাসাত—একসময় নবাবি আমলের স্মৃতিবাহী এই অঞ্চল আজও ইতিহাস ও রহস্যের এক সমাহার। তবে এই শহরের অলিগলিতে এমন কিছু কাহিনি আছে, যা রাতের অন্ধকার নামলেই রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।
বারাসাতে পোদ্দার গলির কাছে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি আছে, যা স্থানীয়দের কাছে “গলাকাটা বাড়ি” নামে পরিচিত। নাম শুনে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে? ঠিকই শুনেছেন—এই বাড়ির ইতিহাস আর লোককথা এতটাই ভৌতিক যে রাতের পর ওদিক দিয়ে যাওয়া প্রায় নিষিদ্ধ বলেই মনে করেন এলাকাবাসী।
ভয়ংকর ইতিহাস
শোনা যায়, এই বাড়িটি ছিল এক ব্রিটিশ সাহেবের। স্বাধীনতার আগে এক ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড ঘটে এখানে। লোকমুখে প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী, সাহেবের একমাত্র কন্যাকে এক রাতে রহস্যজনকভাবে হত্যা করা হয়। মেয়েটির বিকট চিৎকার শুনে পাশের লোকজন ছুটে এলেও কাউকে দেখা যায়নি। তবে সবচেয়ে ভয়ের ছিল—পরদিন সকালে দেখা যায় মেয়েটির মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন! কীভাবে এই ঘটনাটি ঘটেছিল, তা আজও রহস্যাবৃত।
সেই রাতের পর থেকে বাড়িটিতে নানারকম অলৌকিক ঘটনা ঘটতে থাকে—আলোর ঝলকানি, বিকট হাসির আওয়াজ, দরজা-জানালা নিজে থেকেই খোলা-বন্ধ হওয়া ইত্যাদি। এখান থেকেই এই বাড়ির নাম হয়ে যায় “গলাকাটা বাড়ি”।
স্থানীয়দের অভিজ্ঞতা
অনেকেই দাবি করেন, সন্ধ্যার পর পোদ্দার গলির কাছে এলে কানের পাশে কেউ যেন ফিসফিস করে ওঠে। আবার কারও মতে, গভীর রাত হলে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় একটি ছায়ামূর্তি করিডোর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু সবচেয়ে অস্বাভাবিক ব্যাপার হলো, প্রায়শই বাড়ির সামনে একটি কালো বিড়ালকে ঘুরতে দেখা যায়। স্থানীয়েরা তার নাম দিয়েছে “কালী”। ভয়টা তখনই বেড়ে যায়, যখন দেখা যায়, একই সময়ে কালীকে দুই জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে—একদিকে নিজের মালিকের বাড়িতে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে, অন্যদিকে একই কালী সেই পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে চক্কর কাটছে! সাধারণ ঘটনাকে কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দিলেও, যারা নিজের চোখে দেখেছেন, তারা রাতের পর আর কখনোই বাড়িটির কাছে যাননি।
তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়—কালী কি সত্যিই সাধারণ একটি বিড়াল, নাকি অন্য জগতের অস্তিত্বের প্রতীক? এই রহস্যের উত্তর আজও অজানা।

ভূতের ছায়া নাকি মানসিক বিভ্রম?
কেউ বলেন, এটা নিছক কুসংস্কার—পুরনো অন্ধকার বাড়ির জন্যই মানুষ বিভ্রমে পড়ে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা নিশ্চিত—এটা নিছক গল্প নয়। আজও অনেক রাতের প্রহরী বিশ্বাস করেন, ওই বাড়ির জানালা থেকে মাঝেমধ্যে কাউকে উঁকি দিতে দেখা যায়!
আপনি কি যথেষ্ট সাহসী? তাহলে একবার ঘুরে আসতে পারেন বারাসাতের গলাকাটা বাড়ির সামনে দিয়ে! তবে সাবধান—রাতের পর একা যাবেন না, কারণ কে জানে, আপনি হয়তো একা নন!
অপ্রত্যাশিত চারটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল। যাওয়া হলো না Ghost Hunting করতে।
বারাসাতের চার প্রান্তে চারজনের বাড়ি। ঠিক ছিল রাত ১:৩০-এ কলোনি মোড়ে দেখা হবে, তারপর গন্তব্য— পোদ্দার গলির গলাকাটা ভূতুড়ে বাড়ি!
কিন্তু শেষমেশ কিছুই হলো না। যাত্রা শুরু হলেও, শেষ হয়নি।
রাত ১টায় একবার সবার সাথে কথা বলে চারজন রওনা দিল।
রঞ্জন বাইক নিয়ে দক্ষিণপাড়া থেকে, সুজয় বেরোল গুপ্ত কলোনি থেকে, নিলয় বেরোল আর.বি.সি. রোড থেকে, আর আমি কাজীপাড়া থেকে।
রাত ১:৩০ পর্যন্ত কেউ কারও সাথে যোগাযোগ করল না। এরপর একে একে অলৌকিক ঘটনা ঘটতে শুরু করল—
রঞ্জনের ঘটনা
রঞ্জন বাড়ি থেকে বাইকে বেরিয়ে প্রায় ১৪ কিলোমিটার চালিয়েও দক্ষিণপাড়া থেকে কলোনি মোড়ে পৌঁছাতে পারল না!
১১ নম্বর রেলগেট সে তিনবার পার করেছে। দ্বিতীয়বার ভেবেছিল হয়তো চোখের ভুল, কিন্তু তৃতীয়বার নিশ্চিত হলো— কিছু অলৌকিক ঘটছে।
শেষমেশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাকি তিনজনকে ফোনে খবর দিল।

সুজয়ের ঘটনা
সুজয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে রঞ্জনের জন্য অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল।
সে যেহেতু নিচতলায় ছিল, সদর দরজার সিঁড়ির নিচেই থাকা মিটার বক্স থেকে নিজেই MCB তুলল। কিন্তু একের পর এক ৫ বার চেষ্টা করার পরও একই ঘটনা!
MCB তুলতেই ২০-৩০ সেকেন্ডের মাথায় আবার নেমে যাচ্ছে।
এই অবস্থাতেই তার ফোন বেজে উঠল— বাকি তিনজনের ফোন!
নিলয়ের ঘটনা
নিলয় ঘড়ি দেখে ঠিক রাত ১টায় বাড়ি থেকে বাইক বার করল।
বড় রাস্তায় এসে বাইক স্টার্ট দিয়ে হেডলাইট জ্বালাতেই দেখল— কালো পিচের রাস্তায় এক কালো বিড়াল লোম ফুলিয়ে, লেজ উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
যতবার পাশ কাটিয়ে যেতে চায়, বিড়ালটা অদ্ভুত আর্তনাদ করে সামনে এসে দাঁড়ায়, বারবার!
শেষমেশ ফোন বেজে উঠল। তখন ঠিক রাত ১:৩০।

আমার ঘটনা
আমি সেই রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে রাত ১০টায় ফোনে এলার্ম দিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। বই পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।
রাত ১টায় এলার্ম বেজে উঠল। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ঠিকমতো কলোনি মোড়ে পৌঁছালাম।
চারজন মিলে পোদ্দার গলির গলাকাটা ভূতুড়ে বাড়ির দিকে এগোলাম।
কিন্তু আশ্চর্যের কিছুই চোখে পড়ল না!
প্রায় আধঘণ্টা সেখানে কাটিয়ে ফেরার আগে হঠাৎ আমার ফোন বেজে উঠল…
পর মুহূর্তেই দেখি— আমি আমার নিজের ঘরে, নিজের বিছানায়!
ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল— বাকি তিনজনের ফোন!
এক এক করে সবার ঘটনা শুনলাম, আর আমি বললাম আমার স্বপ্নের কথা।
কিন্তু এটা কি স্বপ্ন ছিল? নাকি বাস্তব?
কোনো অদৃশ্য শক্তিই যেন আমার ফোনের এলার্ম রাত ১টায় বাজতে দেয়নি…
পোদ্দার গলির গলাকাটা ভূতুড়ে বাড়ি কি সত্যিই অভিশপ্ত?
বারাসাতের গলাকাটা বাড়ি: এক রহস্যময় সমাপ্তি
সেদিন রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর আমরা চারজন এক জায়গায় বসে আলোচনা করলাম। এতকিছু ঘটে গেল, অথচ আমরা কেউই পোদ্দার গলির সেই গলাকাটা বাড়িতে পৌঁছোতে পারলাম না! তাহলে কি সত্যিই কোনো অলৌকিক শক্তি আমাদের সেখানে যেতে বাধা দিয়েছে? নাকি এটি নিছক কাকতালীয় ঘটনা?
কিন্তু সবচেয়ে অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো— আমার স্বপ্ন! স্বপ্নে আমি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, অথচ বাস্তবে আমি আমার বিছানায় শোয়ায় ছিলাম। এটি কি নিছক মস্তিষ্কের খেলা, নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?
আমরা ঠিক করলাম, এবারের মতো সব কিছু ভুলে থাকব। কিন্তু মন থেকে এই রহস্য কিছুতেই যায়নি।
এক অপ্রত্যাশিত সন্ধ্যা
দুদিন পর বিকেলে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে রঞ্জন একটা খবর পাঠাল—
“বারাসাতে পোদ্দার গলির পরিত্যক্ত বাড়িটি এবার নতুন মালিক পেতে চলেছে!”
খবরটা দেখে আমরা সবাই হতবাক! এতদিনের ভূতুড়ে বাড়ি, যেখানে রাতের পর কেউ যেতে সাহস পায় না, সেটাই কিনে নিচ্ছে কেউ!
পরদিন সকালে আমরা সেখানে গেলাম। দেখতে পেলাম কয়েকজন শ্রমিক বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার করছে, পুরোনো জানালা ও দরজাগুলো সারাই করছে। বাড়ির নতুন মালিক একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক—অরিন্দম বসু। তিনি আমাদের দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন।
“তোমরা কি ভূতের খোঁজে এসেছো?” মজার ছলে তিনি বললেন।
আমরা একে অপরের দিকে তাকালাম, তারপর তাকে রাতের অভিজ্ঞতার কথা বললাম। শুনে তিনি মৃদু হেসে বললেন,
“তোমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি এই বাড়ির ইতিহাস জানি। যে ঘটনা তোমরা ভূতুড়ে বলে জানো, সেটি আদতে এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। ব্রিটিশ শাসনের সময় এখানে সত্যিই একটি হত্যা হয়েছিল, কিন্তু সেটা কোনো অলৌকিক ঘটনা ছিল না—একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। হত্যাকারী ধরা না পড়ার জন্য একগুচ্ছ ভূতের গল্প ছড়িয়ে দিয়েছিল, যাতে মানুষ ভয়ে এখানে না আসে!”
আমরা অবাক হয়ে শুনছিলাম।
তিনি আবার বললেন, “এই বাড়ি এখন আমার। আমি এটাকে নতুন করে গড়ব। ভূতের ভয় থাকলে আসতে পারো না, কিন্তু একদিন তোমাদের সন্দেহ ভুল প্রমাণ হবেই।”
আমরা আশ্বস্ত হলাম। এরপর কয়েক মাস কেটে গেল। নতুন করে বাড়িটি সংস্কার হলো, সেখানে একটি ছোট লাইব্রেরি খোলা হলো। আশ্চর্যের বিষয়, সেই রাতের পর আর কেউ কোনো অলৌকিক ঘটনার কথা শোনেনি!

শেষ কথা
আজ বারাসাতের পোদ্দার গলির সেই বাড়ি আর ভূতের বাড়ি নয়। কুসংস্কার কেটে গেছে, মানুষ অবাধে যাতায়াত করছে।
তবে আমরা চারজন মাঝে মাঝে আলোচনা করি—সেদিন রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কি নিছক কাকতালীয় ছিল, নাকি সত্যিই কিছু অজানা শক্তি আমাদের সতর্ক করেছিল?
কেউ জানে না… আর হয়তো কখনো জানবও না।
(গল্পের সব চিত্র কাল্পনিক।)
বারাসাত, ১৫/০২/২০২৫