Share

জলাতঙ্ক | Aquaphobia

আমি তখন মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ শহরে। বহু কষ্টে একটি দুতলা বাড়ির নিচের তলায় দুটি ঘর নিয়ে বাস করতাম আমারা তিনজন। তিন সহকর্মী, একই আপিস, একই বাড়ি। প্রথম দিকে ঘর পেতে একটু অসুবিধা হয়েছিলো। আমি মুসলিম, এটা শোনার পরে গোটা পাঁচেক ঘর মালিক মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলো। ষষ্ঠ বার মনে হলো আমার সহকর্মীরাও হয়তো আমাকে সঙ্গে নিয়ে সত্যিই ঝামেলায় পড়েছে। আমাকে না পারছে গিলতে, না পারছে ওগরাতে। তিন নির্ঝঞ্ঝাট ছেলে, এটাই ভেবে হয়তো ষষ্ঠ ঘর মালিক আমাদের কে ঘর ভাড়া দিতে রাজী হয়েছিলো। দুই সহকর্মী আগেভাগে আমাকে আমার মুখ খুলতে বারণ করেছিলো ঘর মালিকের সামনে। আমার শুধু নাম বলতে বলেছিল, পদবী ছাড়াই। তিন বছর ছিলাম এই ঘরে, বাড়ি মালিক জানতেই পারেনি।

বাড়ি মালিক এমনি খুব ভালো। সকাল সন্ধায় আমাদের খবর নেন। প্রয়োজনে সব সমস্যায় উনি সাহায্য করতেন। তিন বছরে কোন সমস্যা হয়নি। সমস্যা শুধু জল নিয়ে। ঔরঙ্গাবাদে সে সময় একটু জলের সমস্যা ছিলো। আমাদের বাড়িতে নগরপালিকার জল আসতো সপ্তাহে ৩,৪ দিন। বাড়ির সামনে মাটির নিচে চৌবাচ্চা, এই চৌবাচ্চায় জল এসে জমা হতো। প্রয়োজন মত এই জল পাম্পের সাহায্যে উপরের ট্যাংকে তোলা হতো। বাড়ির ছাদে একটাই বর ট্যাংক। উপর তলা আর নিচ তলা ওই একই ট্যাংকের জল ব্যাবহার করতাম। রান্নাবান্নার কোন ঝামেলা নেই, দুবেলা খাবারের ডাব্বা দিয়ে যেতেন দেশপাণ্ডেজী। এই দেশপাণ্ডেজীর গল্প আগে লিখেছি আমি, আমার ব্লগেই আছে, ইচ্ছে হলে পড়ে নেবেন। ☞ LINK

সপ্তাহে অন্তত একদিন আমরা জলকষ্টে ভুগতাম। ভগবানের কাছে সারা সপ্তাহ প্রার্থনা করতাম যেন রবিবার জলকষ্টে না পড়তে হয়। অন্য দিন সারা দিন আপিসে কাটিয়ে দিতাম, কোন সমস্যা হতো না। কিন্তু যদি রোববার জল না থাকে তাতে আমাদের ভয়ানক সমস্যা। সাপ্তাহিক ঘর পরিষ্কার, জামাকাপড় পরিষ্কার সব এই একটি দিনে। জল না থাকলে সব বন্ধ। সত্যি বলতে পশ্চিমবঙ্গে যত দিন ছিলাম কোন দিন জলকষ্ট কি জানতাম না। চাপা কল, চাপলেই হড় হড়িয়ে জল পেতাম।

যাই হোক, সুখ দুঃখে আমাদের জীবন চলছিলো। বাধ্য হয়ে সব কিছুর সাথে জীবনে মাঝে মাঝে adjust করে নিতে হয়। আমরাও মেনে নিয়েছিলাম। বাড়ি মালিকের কোনো দোষ নেই, জল না আসলে উনি কি করবেন, এটা ভেবেই তার উপরে আমরা রাগ করিনি। আমার মনে গাভীর শ্রদ্ধা ছিল ওনার প্রতি। খুবই নিরিহি এবং মিষ্টি ভাষী। ইলেক্ট্রিক আপিসে চাকরি করতেন। দুই ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে আমাদের উপরে বটবৃক্ষের মত বাস করতেন। ওনার স্ত্রী স্কুল শিক্ষিকা, বড় ছেলে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে আর ছোট ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শেষ বছরে। ছোট ছেলে কখনো বাড়ি আবার কখনো হোস্টেলে।

সেবার বাড়ি মালিক সপরিবারে ১০-১২ দিনের জন্য ছুটি কাটাতে আন্দামান গিয়েছিলো। গোটা বাড়িতে নিচের তলায় আমরা তিনজন। যাওয়ার আগে বাইরের গেটে্র চাবি, জল তোলা পাম্পের তালার চাবি আর ছাদের দরোজার চাবি আমাদের দিয়ে গিয়েছিলো। অনেক সতর্কবাণী ও উপদেশ দিয়ে তিনি বাড়ি ছেড়েছিলেন। আমারা গোপালের মত সুবোধ বালক হয়ে মাথা নেড়ে ওনাকে ভরসা দিয়েছিলাম সব কিছুর খেয়াল রাখার। একটা কাজ উনি আমাদের দিয়ে গিয়েছিলেন। ছাদে অনেক ফুল গাছ আছে, আর প্রত্যেক দিন যেন আমরা সেই গাছে জল দিয়ে আসি। ছাদে ট্যাংকের সাথে পাইপ জোড়া আছে, কল ঘুরিয়ে গাছে জল দিলেই হবে।

সেই প্রথম আমরা ছাদে উঠেছিলাম। সুন্দর পরিস্কার ছাদ, চারপাশে ফুল গাছ। ছাদের এক কনে জলের ট্যাংক। প্রথম কয়দিন আমার শুধু জল দেওয়ার জন্য সকালে কয়েক মিনিটের জন্য ছাদে যেতেম। ক্রমে বিকালেও যাওয়া শুরু করলাম। বিকালে ছাদে উঠলে খুব সুন্দর পরিবেশ ও হাওয়া পাওয়া যেত। সকালে তাড়াহুড়োর মধ্যে ছাদ explore করা হতো না, কিন্তু বিকালে সেটা করতাম। এই explore হয়েছিলো কাল। সব ভক্তি শ্রদ্ধা এক মুহূর্তে কপ্পুরের মত হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলো। এক মুহূর্তে বাড়ি মালিক ভালো মানুশ থেক ধূর্ত শেয়াল হয়ে গিয়েছিলো। ভদ্রতা ছিল তার বাইরের পোশাক, আর পোশাকের ভিতরে ধূর্ত শেয়াল।

জলের ট্যাংকের বর্ণনা শুনলে আপনার বুঝতে পারবেন আমার এইরূপ মন বদলের কারন। একটাই জলের ট্যাংক এবং দুটি জলের লাইন। একটি দোতলার জন্য আর অন্যটি আমাদের নিচের জন্য। একই ট্যাংকের জল থাকলে উপর নিচে দুজনেই জল পাবে। কিন্তু সেরকম তো হয় না। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো ওরা ঘরে অন্য পাত্রে জল ধরে রাখে, তাই জল না থাকলেও ওদের সমস্যা হয় না। কিন্তু আমার এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।

আমরা ছাদে জলের পাইপের যে ডিজাইন দেখেছিলা সেটা ফটোসপ করে বানিয়েছি। আশুন ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিচ্ছি।

১মটি উপরের ঘরের জলের পাইপ আর ২য়টি নিচের ঘরের। দুটো পাইপ সমান লেবেলে ট্যাংকের সাথে যুক্ত। ১মটি সোজা চলে গিয়েছে উপরের ঘরে। আর ২য়টি উল্টো U shape নিয়ে তার পর আমাদের নিচের ঘরে। এবার ধরুন ট্যাংক সম্পূর্ণ ভর্তি, তাহলে দুই পাইপ দিয়ে সমান ভাবে জল পাওয়া যাবে। এবার ভাবুন ৩য় হাতের আঙ্গুল পর্যন্ত জল আছে ট্যাংকে। এ ক্ষেত্রে ১ম পাইপ থেকে জল পাওয়া যাবে, কিন্তু এই আঙ্গুলের নিচে জলের লেবেল নামলেই আর ২য় পাইপ থেকে জল পাওয়া যাবে না, কেবল মাত্র ১ম পাইপেই জল থাকবে।

এই ছিল আমাদের মিটমিটে ঘর মালিক বুড়োর বুদ্ধি। আমাদের ঘরে যখন আমার জলের জন্য হাহাকার করতাম, বুড়ো তখন হয়তো মনের সুখে জলক্রিয়া করত। এটা জানার পর আর কয়েক মাস ছিলাম ওই বাড়িতে। তারপর ব্যাঙ্গালোরে চলে এলাম। আজ হঠাৎ ঘটনাটি মনে পড়লো। লিখে রাখলাম, কেউ না কেউ তো কোনদিন পড়বে।

সঞ্জয় হুমানিয়া
ব্যাঙ্গালোর, ২৮/০৮/২০২০

★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★