[mks_dropcap style=”letter” size=”52″ bg_color=”#ffffff” txt_color=”#000000″]কে[/mks_dropcap]জানতো দশরথ আর আলাউদ্দিন দুই যুগ একই সাথে এক ছাঁদের নিচে একই ঘরে পেয়িং গেস্ট থাকবে? নতুন পাওয়া চাকরিতে যাওয়ার জন্য সকাল সকাল স্নান করছিলো দশরথ, আমি ঘুম থেকে উঠে ব্রাশে ঝাল ঝাল ডাবোর লাল মাজন লাগিয়ে রোদে দাড়িয়ে। হঠাৎ আমি প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম দশরথের দিকে, “সত্যি কি তোমার বেয়াই এর কাছে হরধনু ছিল”? আমার প্রশ্ন শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ও কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। প্রশ্নের তাল সামলে নিয়ে হো!হো!হো! করে হেসে উঠেছিলো দশরথ। আলাউদ্দিন যেদিন প্রথম আমাদের পাশের ঘরে লোটাকম্বল নিয়ে পেয়িং গেস্টের ছদ্মবেশে এসেছিল, সেদিন করমর্দন করার জন্য আমার দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, “হ্যাঁয়, আমি আলাউদ্দিন”। আমিও গম্ভীর ভাবে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলাম, “হ্যাঁয়, আমি খিলজী”। এ ঘোঁটনাতেও আলাউদ্দিন বেশ কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব হয়েছিলো।
লোকে বলে আমি নাকি বাইরে থেকে খুবিই গম্ভীর, আমাকে দেখে নাকি মনেই হয় না যে আমি মজা করতে পারি বা ঠাট্টা তামাশা করতে পারি। প্রকৃতির অদ্ভুত কিছু খেয়ালের বসে আমার বাইরের আর ভেতরের মাঝখানে অনেক খানি ফাঁকা যায়গা রয়ে গিয়েছে। না মশাই, আমি নিজের ঢোল নিজেই পেটাচ্ছি না, শুধু মাত্র ভূমিকা দিলাম নিজের।
সেই ২০০৬ ঘর ছেড়েছিলাম। গুনগুন করে গেয়েছিলাম, “পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি সোজা পথের ধাঁধায় আমি অনেক ধেঁধেছি”। ২০১৮-১৯ সে আমি ব্যাঙ্গালোরে, পেয়িং গেস্ট হিসাবে পাঁচ তলা (পাঁচ তারা নয়) ছাদের উপরের যমজ ঘরের একটিতে থাকি। প্রত্যেক ঘরে দুজন করে বাসিন্দা, দুটি ঘরে আমরা চারজন। এক ঘরে দশরথ আর আলাউদ্দিন, অন্য ঘরে আমি আর আসিফ সিদ্দীকি। ব্যাঙ্গালোরে এই থাকার জায়গার খোঁজ দিয়েছিল এক অচেনা বাঙ্গালী। আমি এক সন্ধ্যায় ব্যাঙ্গালোরে এক বাঙ্গালী এলাকায় সস্থায় থাকা খাওয়ার একটা আস্থানা খুচ্ছিলাম। রাস্তার ধারে দুই বাঙ্গালির কথোপকথন শুনে এগিয়ে গিয়ে আলাপ করে পরিচয় করেছিলাম। ভনিতা না করেই আমার প্রয়োজনের কথা জানিয়ে দিয়েছিলাম। অনেক ভেবেচিন্তে এক ভদ্রলোক একটি ফোন নম্বর দিয়ে বললো, এটা তার কারখানার এক সহকর্মীর নম্বর। এই সহকর্মীটি কোন এক সস্থার PG তে থাকে, এবং উনিই একমাত্র আমাকে উদ্ধার করতে পারবে থাকা খাওয়ার সমস্যা থেকে।
এখানে এখন দিব্যি আছি, সকলেই যেন কত দিনের চেনা, কত পরিচিত। মানুষ কত সহজে পরিচিত হয়ে যায়, আবার কত মানুষ কত সহজেই অপরিচিত হয়ে যায়। আমরা প্রতেকেই কিন্তু একেঅপরের সমন্ধে বিশেষ কিছু জানিনা, তবুও কত পরিচিত মনে হয়। কোন দিন আপিস থেকে ফিরে যখন দেখি যমজ ঘরে কেউ নেই, মাঝে মাঝে সত্যিই খুব একা লাগে। এই একা লাগার অনুভবটা বাড়ির লোকর অনুপস্থিতি অনুভব করার মত নয়, একমুঠো অচেনা মানুষের অনুপস্থিতি কে অনুভব করা। এই সব অচেনা মানুষদের সঙ্গ কিন্তু বেশীদিনের সম্পর্ক হয় না, হয়তো ৬ মাস, ১ বছর বা ২ বছর। তার পর এরা সকলেই স্মৃতি। আমি এমন অনেক স্মৃতি নিয়ে ঘুরে বেড়াই। মাঝে মাঝে পুরনো ছবি দেখি আর তাদের কথা মনে করি। হয়তো আর কোনদিন দেখা হবে না তাদের সাথে সামনাসামনি। এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে চ্যাট কমেন্ট বা কথা হয়তো হবে, তবে স্বচক্ষে দেখা কি হবে?
শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলে গিয়েছেন, “মানুষ আপন টাকা পর যত পারিস মানুষ ধর”

Image courtesy : Aparajito (Film)