
আমার দাদিমা (ঠাকুমা)
মাঝে মাঝে ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়ে। আগে যখন মনে পড়তো আমি মনে মনে একা একাই হাসতাম, এখন লিখে রাখি। কি জানি, হঠাৎ করে হয়তো একদিন সব ভুলে যাবো। প্রথম দিকে শুধু লিখেই রাখতাম, তার পর হঠাৎ একদিন ভাবলাম, আমি তো কোন সাহিত্যিক বা লেখক নই, কিম্বা কোন দিন এই সব লেখা কেউ বই আকারেও ছাপবে না। তাই একটি ওয়েবসাইট বা ব্লগ বানিয়ে লেখা ইন্টারনেটে জুড়ে দিলাম। কেউ না কেউ তো একদিন না একদিন আমার স্মৃতি পড়বেই আর কাকতালীয় ভাবে তার নিজের স্মৃতির সাথে হয়তো অনেক মিল খুজে পাবে। আমার স্মৃতিতে কোন গল্প নেই, দৈনন্দিন জীবনযাত্রা আর চলে যাওয়া সময়ের কিছু ঝাপসা টুকরো টুকরো ছবি।
আমি তখন হাফপ্যান্ট পরি, বয়স কত মনে নেই। ‘দাদা’ অর্থাৎ ঠাকুরদা (আমার বাবার বাবা) তখনো বেঁচে আছেন। আমরা মুসলিমরা ঠাকুরদা কে সাধারণত দাদা আর ঠাকুমা কে দাদি/দাদিমা বলেই ডাকে সবাই। দাদির আদর ও শাসন দুটোই আমি পেয়েছি, শুধু পেয়েছি বললে ভুল হবে, আমি সব থেকে বেশী পেয়েছি। আদর করে দাদি আমাকে সঞ্জু ভাই বলে ডাকতেন। মাঝে মাঝে আদর করে বলতেন, আমিই নাকি তার ‘শাহাদাত’ ভাই। অনেক বার শুনেছি দাদির একটা ভাই ছিল, নাম ‘শাহাদাত’। হয়তো ভাই কে খুব ভালবাসতেন দাদিমা, এবং সেই একই পরিমান ভালবাসা আমাকেও দিয়েছিলেন তাই আমার মধ্যে সেই ‘শাহাদাত’ কে খুঁজে বেড়াতেন। আমাকে আদর করার সময়, আমার থুতনিতে পাঁচটা আঙ্গুল ছুইয়ে আঙ্গুল গুলি নিজের ঠোঁটে লাগিয়ে চুমু খেয়ে হাসিহাসি মুখ করে আমাকে কোলে নিয়ে আদরের সুরে বলতেন – “আমার ছোট্ট শাহাদাত ভাই।”
দাদা অর্থাৎ ঠাকুরদা ছিলেন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ আমার কাছে। দাদার তেমন কোন স্মৃতি মনে নেই আমার, শুধু কয়েকটা আপছা ঘটনা ছাড়া। আমার ঠিক মনে নেই, তবে যতদূর মনে পড়ে দাদা একবার আমাকে আর আমার দিদিকে জামাকাপড় কিনে দিয়েছিলেন, মাত্র এইটুকুই মনে পড়ে। সাধারণত আমাদের বাড়ির কেনাকাটা হাবড়া থেকেই করা হয় বা হতো। সোহনলাল তাপুড়িয়া থেকেই বেশীরভাগ জামাকাপড় কেনা হতো। হাবরায় যারা থাকেন তারা অবশ্যই চিনবেন এই বিখ্যাত জামাকাপড়ের দোকান।
ঘটনটা আমার কাকার বিয়ের পরের ঘটনা। কাকারা বিয়ের টুকরো টুকরো ঘটনা আমার মনে আছে এখনো। সেই সময় বিয়েতে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার প্রচলন ছিল কি না আমার জানা নেই। হয়তো উচ্চবিত্ত মানুষদের মধ্যে সে প্রচলন ছিল তবে মধ্য বা নিম্নবিত্ত পরিবারের মধ্যে এই প্রচলন ছিল না। ছবি তোলা বা ছবি ওঠানো বলতে আমি জানতাম স্টুডিওতে গিয়ে ছবি ওঠানো। হয়তো বিয়ের কিছুদিনের পরের ঘটনা এটা। হঠাৎ একদিন কানে এলো কাকা আর কাকিমা কোন একদিন কালার অথাৎ রঙ্গিন ছবি ওঠাতে হাবড়া যাবে। সে সময় আমাদের বাড়িতে সাদাকাল ছবি দেখেছি, আমার নিজেরই দুটো ছোটবেলার ছবি ছিল। একটা ছবিতে আমি হামাগুড়ি দিচ্ছি আর দ্বিতীয়টিতে আমি একটা গোল চেয়ারে বসে আছি। এই গোল চেয়ারে বসা সাদাকাল ছবি মোটামুটি সব বাড়িতেই পাওয়া যেত সেই সময়। কিন্তু রঙ্গিন ছবি সবে তখন শুরু হচ্ছে আমাদের ওই এলাকায়। আমি মনে মনে ছক কসে ফেললাম, যেমন করেই হোক কাকা-কাকিমার পিছু নিতে হবে আর রঙ্গিন ছবি তুলতেই হবে।
কোনো এক সকালে উঠে শুনলাম কাকা-কাকিমা হাবড়া যাবে ছবি ওঠাতে। ব্যাস!! মায়ের কাছে আমার ঘ্যানঘ্যান শুরু, “আমিও যাবো, ছবি ওঠাবো”। ঠিক বেরোবার সময় আমার কান্নার ধুম পড়ে গেলো। বাধ্য হয়ে আমাকে আর দিদি কে সঙ্গে নিয়েই ছবি তুলতে গিয়েছিল কাকা আর কাকিমা। স্টুডিও আগমনী, সেই সময় বেশ নামকরা ছবি তোলার স্টুডিও ছিল হয়তো। দোকানের সামনে সাইনবোর্ডে বড়বড় করে লেখা – স্টুডিও আগমনী, যশোহর রোড, হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা, (কালিকা সিনেমা হলের নিকটে)। সেই প্রথম আমি আসল ক্যামেরা দেখেছিলাম। দোকানের চারিদিকে কাঁচ লাগানো আর অনেক ছবি সাজানো ছিল। কত অচেনা মুখ, কত স্টাইলে ছবি ওঠানো। কাকা কাকিমার ছবি ওঠানোর পর আমি আর দিদি ছবি তুলবো। আমি বসে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। স্টুডিওতে বড় একটা ঘর কে দুটো ভাগে ভাগ করা। প্রথমে ঢুকেই একটা ঘর, যেখানে প্রচুর ছবি সাজানো আছে কাঁচের দেওয়ালে। আর তার পরেই একটা কাঠের দরোজা ঠেলে ঢুকতে হয় অন্য একটা ঘরে। এই ঘরের একটি দেওয়ালে খুব সুন্দর বড় বড় ছবি আকা আছে। বড় ছবির উল্টো দিকে একটা ড্রেসিং টেবিল সঙ্গে ছোট্ট একটা বসার টুল। একটা স্ট্যান্ড এর উপরে একটা তোয়ালে চাপা দেওয়া কি একটা দাড়িয়ে আছে। বড় বড় আলো, বিভিন্ন ধরনের ফুলদানি, ছোট বড় চেয়ার, টুপি, কাঠের টাট্টু ঘোড়া আর বিভিন্ন খেলনা ঘরের এদিক ওদিক সাজিয়ে রাখা আছে। আমি মনে মনে পছন্দ করে ফেললাম একটা তিন চাকার সাইকেল রিক্সা আর একটা বন্দুক। মনে মনে ভাবলাম দুটো ছবি তুলবো, একটা সাইকেলে আর অন্যটি বন্দুক নিয়ে। এদিকে একজন লোক ঘরে ঢুকে সেই তোয়ালে সরিয়ে ফেললো, আমি অবাক হয়ে দেখলাম আসল ক্যামেরা। এই প্রথম দেখলাম ক্যামেরা কেমন হয়। কাছে যাওয়ার সাহস পাইনি তখন, দূর থেকেই দেখলাম।
কাকা কাকির ছবি তোলা শেষ এবার আমাদের পালা। ক্যামেরা ম্যান আমাকে আর দিদি কে একটা লম্বা কাঠের বেঞ্চে বসতে বলল। আমি বুঝে গেলাম মনের ভাব প্রকাশ করার এই সময়, এখন চুপ করে থাকলে চলবে না। চুপ করে থাকলে সাইকেল আর বন্দুক নিয়ে আমার আর ছবি তোলা হবে না। আমি কাকা কে বললাম, আমি ওই তিন চাকার সাইকেল নিয়ে ছবি তুলবো। হঠাৎ দিদিও বলে উঠলো, কাকিমার গলার হার নিয়ে ছবি তুলবে। মনে মনে শুধু আমি ছক কোষছিলাম না, দিদিও কোষছিল। গলার হার সহজেই পাওয়া গেলো, কিন্তু তিন চাকার রিক্সা সাইকেল অতটা সহজে পাওয়া যায়নি। অনেক খুতখুত করে তার পর পেয়েছিলাম। সেই সময় হয়তো এই সব জিনিস স্টুডিও থেকে নিয়ে ছবি তুলতে একটু বেশী টাকা লাগত। হয়তো ওই তিন চাকা রিক্সা সাইকেলের ভাঁড়া লেগেছিল, তাই ওটা সহজে পাওয়া যায়নি। আমার আর দিদির পরনে দাদ/ঠাকুরদার দেওয়া জামা। হলুদ রঙের হাফপ্যান্ট পরে আর হাফশার্ট পরা আমি, তিন চাকা রিক্সা সাইকেলে বসে আর দিদি আমার পিছনে দাড়িয়ে একটা ছবি তোলা হোলো।
এবার আমার দ্বিতীয় বায়না শুরু হোলো। বন্দুক নিয়ে ছবি তুলবো। আমার খুঁতখুঁতানি শুরু হয়ে গেলো, আমি কিছুতেই ওই ঘর থেকে বেরবো না। সবাই বোঝাতে শুরু করলো পরে একদিন এসে বন্দুক নিয়ে ছবি তোলার কথা, কিম্বা বোঝাতে শুরু করলো ক্যামেরার রিল শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি নিজের প্রতিজ্ঞায় অনড়। ছবি আমি তুলবোই। শেষে কেমন করে সবাই যেন রাজি হয়ে গেলো। আমি বন্দুক হাতে, ডান হাতে বন্ধুক উঁচিয়ে সামনে তাকিয়ে আছি, ডান পা একটু এগিয়ে দিলাম। ঠিক যেমন আমাদের সাদাকাল টিভিতে দেখায়, ঠিক তেমন। ফ্ল্যাশের আলো জ্বলেছিল, ক্যামেরায় খট করে আওয়াজও হয়েছিলো।
এক সপ্তাহ পরে কাকা একদিন ছবি বাড়ি নিয়ে এলো। আমি তো আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারছিলাম না। মনে মনে ভাবছিলাম, আমারও বন্দুক নিয়ে ছবি!! সিনেমার নায়কের মত!! উফ!! ভাবা যায়। কাগজের খাম থেকে প্রথমে কাকা কাকিমাদের দুটি ছবি, তার পর দিদি আর আমার ছবি বেরিয়ে এলো। আমার চোখ কিন্ত চতুর্থ ছবি খুঁজে বেড়াচ্ছে। সবাই যখন তিনটি ছবি দেখাদেখি করছে, আমি সেই ছবির খাম হাতে নিয়ে তার ভিতরে চতুর্থ ছবি খুঁজে বেড়াচ্ছি। খাম তো খালি!! সে ছবি তো নেই!! আমি কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে উঠলাম – “আমার বন্দুক নিয়ে ছবিটা কই?”। উত্তরে কানে এলো, “ছবিটা ওঠেনি, বেশী ফ্লাশে ছবি জ্বলে গিয়েছে”। আমার তখন চোখ জলে ঝাপসা, অভিমানে ফোঁপাতে শুরু করেছি। মা বুঝতে পেরে কোলে তুলে নিল। আমার সেই বন্দুক নিয়ে ছবি কোথায় হারিয়ে গেলো।