সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলার উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা থানার অন্তর্গত চড়ুইগাছি গ্রাম—স্বপ্নের মতো নিসর্গে ভরা এক গ্রাম। কিন্তু ১৯৮৩ সালের ১২ই এপ্রিল (২৮শে চৈত্র ১৩৮৯) মঙ্গলবার এই গ্রামে নেমে এসেছিল এক অমানিশার কালো ছায়া। এক ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় মুহূর্তেই গ্রাস করে নেয় গ্রামজীবনের শান্ত ছন্দ। এটি ইতিহাসে “Gaighata Tornado of 12 April 1983” বা সাধারণভাবে “গাইঘাটা টর্নেডো” নামে পরিচিত।
ঘূর্ণিঝড় কীভাবে নাম পেল
“ঘূর্ণিঝড়” শব্দটি বাংলার প্রচলিত নাম হলেও, বিজ্ঞানীরা একে বলেন ট্রপিক্যাল সাইক্লোন। ‘Cyclone’ শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ Kyklos (কাইক্লোস) থেকে, যার অর্থ বৃত্ত বা চাকা। প্রকৃতির এই চক্রাকার ঘূর্ণি ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হয়েছে বহুবার, তবে গাইঘাটার এই ঘটনাটি আজও মানুষের মনে থেকে গেছে এক তীব্র ক্ষতের মতো।
সরকারি ও গবেষণালব্ধ দলিল
এই ঘূর্ণিঝড়কে নথিভুক্ত করা হয়েছে সরকারি দপ্তরের রিপোর্টে—North 24 Parganas জেলার ওয়েবসাইটে এটি উল্লেখ আছে “1983 Tornado at Gaighata Development Block” নামে। সরকারি হিসেবে ২৮-৩০ জন নিহত এবং ৫০০+ জন আহত বলে উল্লেখ আছে, যদিও স্থানীয়দের দাবি বাস্তবে হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি ছিল।
বিজ্ঞানী অনুপম সাহা (Anupam Saha), বি কে দে (B.K. De) এবং এস কে সরকার (S.K. Sarkar) তাদের গবেষণাপত্রে (June 1984, CSIR-NISCAIR, Spectral Characteristics of the Gaighata Tornado of 12 Apr. 1983) বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতার কথা তুলে ধরেছেন। লেখক এস.সি. ভট্টাচার্যও তার বই Land and People of Indian States and Union Territories-এ সংক্ষিপ্তভাবে এই ঘটনার উল্লেখ রেখেছেন।
১২ এপ্রিল ১৯৮৩: চোখে দেখা কাহিনি
প্রচণ্ড শব্দে আকাশ অন্ধকার হয়ে আসে। গ্রামের মানুষ বলে—শো-শো আওয়াজে মনে হচ্ছিলো আকাশ ফেটে পড়ছে। মুহূর্তের মধ্যে গ্রামের অর্ধেকাংশ তছনছ হয়ে যায়। কারও ভিটেমাটি ছিন্নভিন্ন, কারও প্রাণহানি। গ্রামজুড়ে আতঙ্ক, কান্না আর ধ্বংসস্তূপ।
গ্রামের প্রবীণ মানুষদের মুখেমুখে এখনো ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী দৃশ্যের করুণ কাহিনি শোনা যায়—
- নারকেল গাছে ধান ঝাড়া কুলো তীরের মতো বিদ্ধ পাওয়া গিয়েছিল।
- পুকুরের সমস্ত জল ও মাছ উড়ে গিয়ে আশপাশের শুকনো জমিতে ছিটে পড়েছিল।
- ধানের গোলা উড়ে অন্য গ্রামে গিয়ে পড়েছিল, ধান ছড়িয়ে গিয়েছিল চারদিকে।
- কাঁচা ঘরের মাটির দেয়ালের নিচে চাপা পড়া মৃতদেহ, পাশে তখনো রয়ে গিয়েছিল ভাত খাওয়ার থালা।
- টালির চাল, ঘরের জিনিসপত্র, বিশাল গাছ উপড়ে গিয়ে ভেঙে পড়েছিল চারিদিকে।
এই মানুষজনের ভাষ্যই আজ মূলত ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ সে সময়ে না ছিল মোবাইল ক্যামেরা, না ছিল সোশ্যাল মিডিয়ার নথি সংরক্ষণের সুযোগ।
প্রভাব ও বিস্তৃতি
গাইঘাটা টর্নেডো শুধু একটি গ্রামকে নয়, পুরো অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রাকেই পরিবর্তিত করে দিয়েছিল। বহু পরিবার হারিয়েছিল প্রিয়জনকে, আবার অনেকেই দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছিলেন। সরকারি সাহায্য তখন সীমিত ছিল, আর সংবাদপত্রের সামান্য কয়েকটি রিপোর্ট—সেই সূত্র ধরেই হয়তো আজও আমরা জানি এই ভয়ঙ্কর দুর্যোগের কথা।
আজকের পাঠ ও প্রাসঙ্গিকতা
আজকের দিনে আধুনিক প্রযুক্তি, আবহাওয়া দপ্তরের সতর্কবার্তা ও সংবাদমাধ্যমের দ্রুত প্রচার আমাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচাতে সাহায্য করছে। কিন্তু ১৯৮৩ সালের গাইঘাটা ঘূর্ণিঝড় আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে মানুষ কতটা অসহায় হতে পারে। একইসঙ্গে, আমাদের গ্রামের মানুষের সাহস, ধৈর্য এবং পুনর্গঠনের ইচ্ছে এও প্রমাণ করে—প্রকৃতির যে কোন দুর্যোগের পর মানুষ উঠে দাঁড়াতে জানে।
আপনার কাছে যদি এই ঘটনাটির আরও কোনো তথ্য, ছবি বা দলিল সংগ্রহে থাকে, আমাদের সঙ্গে শেয়ার করুন। লিখুন কমেন্টে অথবা যোগাযোগ করুন ইমেইলে: sanjay.humania@gmail.com
Information source:
- north24parganas.gov.in
- Gaighata Tornado of 12 Apr. 1983
- Land and People of Indian States and Union Territories
এই ছবিগুল আমি সংগ্রহ করেছি রামিজ হুমানিয়া ও সালেক মুফতি এর কাছ থেকে, দুজনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।









Last image is regenerate with realastic hd colour using AI
 
			        


 রূপ কথা
রূপ কথা         বিজয়া দশমীর রাতের গল্প
বিজয়া দশমীর রাতের গল্প         কালচক্র
কালচক্র         শামুকের মুক্তি
শামুকের মুক্তি         অভিমানী বাবী
অভিমানী বাবী         বৃষ্টির দিনে সেই প্রথম
বৃষ্টির দিনে সেই প্রথম         ফেসবুকের অভিনন্দন পত্র
ফেসবুকের অভিনন্দন পত্র         এক মুঠো অচেনা মানুষ
এক মুঠো অচেনা মানুষ