স্থান: আমাদের চড়ুইগাছি গ্রাম, কাল: ৯০এর দশক, পাত্র: আমি, গল্প হলেও সত্যি। তখনোও পর্যন্ত আমি জানতাম মাথার চুল কাঁটা হয় দুই প্রকার। প্রথম নেড়া হওয়া আর দ্বিতীয় তেল-কম ছাঁট বা কদম ছাঁট বা বাটি ছাঁট। সেলুন নামে যে একটি শব্দ আছে আমি জানতাম না। নেড়া হওয়া খুব সহজ, আমার মা একটা ‘অশোক’ নামক কোম্পানির ব্লেড দিয়ে খর-খর করে আমায় মাথা নেড়া করে দিতো। প্রথমে অল্প জল/পানি দিয়ে মাথার চুল ভিজিয়ে নিয়ে, বেশ ভালো করে সাবান মাখিয়ে, ব্লেড একটি রেজারে লাগিয়ে কামিয়ে দিতো আমার মাথা। দ্বিতীয়বার শুধু জল মাথায় লাগিয়ে ব্লেডের অন্য দিক দিয়ে ফিনিশিং টাচ। চকচকে নেড়া মাথা আপনাদের সামনে। আর দ্বিতীয় প্রকারের চুল কাঁটা হলো নাপিতের কাছে গিয়ে চুল কাটানো।
ছোট থেকেই আমার মাথার চুল খুবই মোটা আর খাঁড়া-খাঁড়া। একটু ছোট করে চুল কাটলেই সব মাথার চুল যেন এক সাথে বিদ্রোহ করে উঠে দারিয়ে পড়তো। এই দাড়িয়ে থাকার প্রতিবাদী বিদ্রোহ চলতে থাকতো কয়েক সপ্তাহ। তার পর বিদ্রোহের আগুন আস্তে আস্তে কমতে থাকতো আর একে একে দাড়িয়ে থাকা চুল ঘাড় ও মাজা ভেঙ্গে ঝুকে পড়তো, আর শেষমেশ শুয়ে পড়তো।
নাপিত! খাটো করে পরা একটা পাতলা সাদা ময়লা ধুতি, গায়ে তেলচিটে একটা ফতুয়া, পায়ে অনেক পথ হেটে খয়ে যাওয়া হাওয়াই চটি, হাতে একটি মোটা কাপড়ের তৈরি থলে। মাথায় চিপচিপে তেল, লম্বা লম্বা চুল পরিপাটি করে বাম দিকে সিতে কাটা। লম্বা নাক, গোঁফ দাঁড়ি মসৃণ করে কামানো। ইনিই আমাদের গ্রামের এক মাত্র নাপিত, কিন্ত ইনি আমাদের গ্রামের নন, বাড়ি অন্য গ্রামের। সপ্তাহে একবার, রবিবার আমাদের গ্রামে আসতেন এবং সারা গ্রামের দাঁড়ি-গোঁফ কামিয়ে, চুল ছেঁটে বিকালে ফিরতেন নিজের গ্রামে।
যশোর রোড ছেঁড়ে কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে একটু হাঁটলেই আমাদের গ্রাম শুরু। প্রথমের বাম হাতে চড়ুইগাছি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, আর একটু এগোলে বাঘার পুকুর। মস্ত বড় এক পুকুর, থৈথৈ জল। আর একটু সামনে এগোলেই বটতলা। এখন আর নেই সেই বুড়ো বটগাছ নেই। বেশ কয়ক বছর হলো সে গাছ ঝড়ে উপড়ে গিয়েছে। এই বুড়ো বটগাছের থেকেই ওই স্থানের নাম হয়েছিলো ‘বটতলা’ আর পাশের পুকুরের নামে নাম হয়েছিলো ‘বাঘার পুকুর’। এই বটতলা থেকেই গ্রামের বসতি শুরু। আমাদের এই এক মাত্র নাপিতের কাজও শুরু হতো এখান থকেই। বটতলা আমাদের গ্রামের দক্ষিন দিক, আর আমাদের বাড়ি আর একটু উত্তরে এগিয়ে। যদিও গ্রামের উত্তর পাড়া অনেক দূর, আমাদের বাড়ি দক্ষিণ পাড়াতেই।
আমার ঠাকুমা তখন জীবিত ছিলেন। নাপিত কে ডেকে আনতেন তিনি, বসাতেন আমাদের পুকুর পাড়ে জামরুল গাছের ছায়ায়। স্নান করতে আসা গ্রামের অন্যারাও স্নানের আগে কামিয়ে নিতো দাড়িগোঁফ। ঠাকুমা জামরুল তলা থেকে খিড়কির দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলতো আমার মা কে, –
“মা, নাপিত এয়েচে। সঞ্জুর চুল অনেক বড় বড় হয়েচে, মাথা মোটা লাগচে, চুল কাটিয়ে নে”
সঞ্জু তখন কথায়? সঞ্জু আগেই বুঝতে পেরেছিল যে নাপিত আসবে এবং তার চুল আজ আবার বিদ্রোহ করবে। বাড়িতে খোঁজ-খোঁজ শুরু হয়ে যেতো। দিদি খুঁজছে, মা খুঁজছে, ঠাকুমা খুঁজছে। দুটো শোয়ার ঘর, একটি খোলার ঘর, দুটি টালির ঘর, রান্না ঘর, গোয়াল ঘর আর বাইরের উঠোন, সঞ্জু কে খুজে পাওয়া গেলো না। আমাদের গ্রামের বাড়ি একটু উঁচু মাটি থেকে। কোমর পর্যন্ত উঁচু হবে। চার ধাপের একটা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয় বারান্দায়। ঠাকুমা সবে মাত্র বাইরের উঠোন ঘুরে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ঢুকছে, শোয়ার ঘরের দরজা খোলা, মা বারান্দার এক পাশে দাড়িয়ে। হঠাৎ ঠাকুমার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো আমার। আমাদের সদর দরজা দিয়ে ঢোকার সময় যদি কেউ সোজা হয়ে বাড়ির দিকে তাকায়, আর যদি শোয়ার ঘরের দরজা খোলা থাকে, তবে খাটের নিচেটা পরিস্কার দেখা যায়। আমি তখন খাটের নিচে হাঁটু ভাজ করে উপুড় হয়ে বসে আছি, পাঁশে ছড়িয়ে আছে শুঁকনো ঝুনো নারকেল। এক গাল হেঁসে ঠাকুমা বলে উঠলো, –
“এই দেখ মা, তোর সঞ্জু খাটের নিচে”, বলেই হেঁসে উঠতেন। আমার লুকোচুরি খেলা শেষ”
আমি একটি কাঠের পিড়ের উপরে বসে আছি, খালি গায়ে, আর নাপিত একটা ইটের উপরে বসে আছে ‘তে-মাথা’ হয়ে। বয়স বাড়লে লোক যখন হাঁটু ভাজ করে মাটিতে বসে তখন দুই হাঁটু আর মাথা প্রায় সমান উচ্চতায় থাকে এবং একেই ‘তে-মাথা’ বলে। আমার চোয়াল নাপিতের দুই হাঁটুর মাঝখানের, NO নড়ন-চড়ন। কোন এক লোহার কারখানায় যেমন Bench Vice ব্যাবহার করা হয় কোন একটি ছোট্ট বস্তুকে শক্ত করে আটকে রাখার জন্য, ঠিক তেমনি এই নাপিতের হাঁটু জোড়া আমার মাথা কে শক্ত করে আটকে রেখেছে। যাতে এক হাতে কাঁচি আর অন্য হাতে চিরুনি নিয়ে নির্বিঘ্নে চুল ছাঁটতে পারে।
ঠাকুমা মুখে জোরে জোরে বলতো, –
“আমার সঞ্জু ভাইয়ের চুল যেন বেশি ছোট করে না কাটা হয়”
কিন্তু ইসারায় বুঝিয়ে দিতেন, আমার যেন তেল-কম ছাঁট দেওয়া হয়। তেল-কম নামক ছাঁট সত্যি আছে কি জানি না, তবে আমার ঠাকুমা এই শব্দটি ব্যাবহার করতেন। সারা মাথার চুল ছোট করে কাটা হলে অল্প তেলেই সারা মাথায় তেল মাখা যায়। এই সুত্র থকেই ‘তেল-কম ছাঁট’ নামক চুলের কাটিং এর নাম দিয়েছিলেম আমার ঠাকুমা।
নাপিতের থলি থেকে একে একে বেরিয়ে আসতো কত দিনের চেনা পরিচিত কয়েকটা জিনিস।
১) দুটো/তিনটে কাঁচি
২) খুর
৩) ছোট্ট একটা চামড়ার ছেড়া বেল্ট
৪) ছোট্ট একটা সাবান বাক্স
৫) গেঁজা বা ফ্যানা করার তুলি
৬) এক টুকরো ফিটকিরি
৭) ছোট বড় দাঁড় ভাঙ্গা চিরুনি
৮) লোহার বাটি
৯) একটা ঝাপসা আয়না
আয়নার ব্যাবহার শুধু মাত্র প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য, আমাদের জন্য না। বাংলা সাইকেলে যে ঘণ্টা বা বেল আজও ব্যাবহার হয়, তার উপরে এক ধরনের বাটির মত দেখতে একটা লোহার ঘণ্টা থাকতো। একটি বল্টু দিয়ে আটকানো থাকে। আমাদের এই নাপিতের লোহার বাটি এটাই। লোহার এই বাটির বল্টু লাগানোর ছিদ্রে একটা অ্যালুমিনিয়াম এর রেভিট লাগানো। এই বাটিতেই বারে বারে অল্প জল ঢেলে নিয়ে নিজের কাজে লাগাতো। আমার মাথায় এই ছোট্ট বাটি থেকে জল নিয়ে ভেজানো হতো। ভালো করে চুল ভিজিয়ে নিয়ে খচাং খচাং শব্দ করে আমার সখের চুল কাটা শুরু হতো। আমার তখন, চোখে নামে বৃষ্টি, বুকে ওঠে ঝড় যে, তুমি তো আমারই ছিলে, আজ কত পর যে।
চুল কাটা শেষ হলে আমি চোখ আর নাক মুছতে মুছতে খিড়কির দরজা দিয়ে বাড়ি ঢুকতাম। ঠাকুমা পিছনে বলতে বলতে আসতেন, –
“এই তো, এই কদিনেই আবার চুল বড় হয়ে যাবে”
এই কথা শুনেই আমি আবার ফুঁপিয়ে কেদে উঠতাম। আয়নার সামনে আমি নিজেকে কেমন অচেনা অসহায় দেখতাম। মাথায় তখন দাড়িয়ে আছে বিদ্রোহী চুল। চিরুনি দিয়ে যতই তাদের শোয়ানোর চেষ্টা করি, ততই তারা আরও জোরে বিদ্রোহ করে। এক সময় আমি হেরে জেতাম এই দাড়িয়ে থাকা বিদ্রোহী চুলের কাছে। স্নানের পর মা কোলে নিয়ে ভাত খাওয়াতে বসতো। আমি গোমড়া মুখে ভাত খাচ্ছি তাই মা বলেছিলো, –
“খেয়ে নে, বিকালে হাবরা যাবো। তোর জন্য একটা মিঠুন চেক জামা কিনে দেবো আর আপ্যায়ন থেকে ছানার পায়েস খাওয়াবো”