আমি কাঠের পুতুলের মত সরে দাঁড়ালাম
আজ আমি মাঝবয়সী, কত স্মৃতি জমে আছে মনের আনাচেকানাচে। কত কিছুই না ঘটে যায় প্রতিদিন, কতটুকুই আমরা মনে রাখি, কতটাই স্মৃতি হয়ে রয়ে যায় মস্তিস্কে। এখানে মস্তিস্ক কথাটা ব্যাবহার করার পিছনে বড় একটা কারণ আছে। আমার মূল স্মৃতিতে যাওয়ার আগে ছোট্ট করে মস্তিস্ক নিয়ে আমার যা ধারনা তা একটু বলে দেই।
আমার আমাদের আলাদা আলাদা অনুভুতি শরীরের আলাদা আলাদা অঙ্গের সাথে জুড়ে রেখেছি, যেমন –
‘নাকে সুন্দর মাংস রান্নার সুগন্ধ পেলাম’ বা ‘তোমার গান শুনে আমার কান জুড়িয়ে গেল’ বা ‘তোমাকে দেখে আমি চোখে শান্তি পাই’ অথবা ‘বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে সত্যি মন থকে ভালবাসি’ কিম্বা ‘আজ কাল মাথায় অনেক বুদ্ধি কিলবিল করছে’।
আমার প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা, আবেগ, সহানভুতি, কষ্ট বা এই ধরনের আবেগ কে আমাদের হৃদয় এর সাথে জুড়ে দেই। হৃদয় অর্থাৎ হৃৎপিণ্ড। কাউকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে গিয়ে সুন্দর করে হৃদয় এর ছবি এঁকে, তার উপরে “আই লাভ ইউ” লিখে পাঠাই। কিম্বা হিন্দি গান গেয়ে ফেলি প্রেমিক প্রেমিকার মানঅভিমানের যখন পালা চলে, “দিল চির কে দেখ, তেরাহি নাম হোগা”।
এখানেই আমার সমস্যা, সত্যি কি আমাদের হৃৎপিণ্ড এত কিছু কর? আমি যত দূর জানি, আমাদের হৃৎপিণ্ডের একটাই কাজ, তা হল রক্ত পাম্প করে সারা দেহে রক্ত চালনা করা। হৃৎপিণ্ডের কাছে অত সময় কোথায়? এত সব আবেগি কাজ করার জন্য? আমার যেটা মনে হয়, সেই প্রাচীন কাল থেকে একটা ষড়যন্ত্র চলে আসছে, আর এখনো চলছে। বেচারা হৃৎপিণ্ড কে যুগের পর যুগ বদনাম করা হয়েছে আর আজও হচ্ছে। এই যে প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা, আবেগ, সহানভুতি, কষ্ট বা এই ধরনের আবেগ সম্পরকে হৃৎপিণ্ড কিছুই জানে না, তবুও আমারা এই সবই তার উপরে চাপিয়ে দেই। বেচারা হয়তো জানেই না যে যুগযুগ ধরে এই সব তার উপরে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আর এই ভয়ানক চক্রান্তের পিছনে আছে আমাদের মস্তিস্ক। ভয়ানক ঝানু মাল এই মস্তিস্ক। আমাদের সব অনুভুতি দেখাশোনা করে এই মস্তিস্ক, কিন্তু আবেগি অনুভুতি গুল খুব কায়দা করে বেচারা হৃৎপিণ্ডের উপরে চাপিয়ে দিয়েছে। আপনি অল্প বয়সে অন্ধ প্রেমে হোড়কে গিয়েছেন? দোষ কিন্তু ওই হৃৎপিণ্ডের। মস্তিস্ক কোন দিন এর দায়ভার নেবে না। হিন্দি সিনেমার বিখ্যাত ডাইলগ – “ইস্ক আউর জং মে সব কুছ জায়েজ হে, দিল সে সচো, দিমাগ সে নাহি”।
সুতরাং, হৃদয় দিয়ে আমারা কোন ভাবনাচিন্তা করি না, হৃদয় থেকে আবেগি হই না, হৃদয় থেকে কাউকে ভালোবাসি না। সব কিছু করি মস্তিস্ক দিয়ে। হৃদয় বা হৃৎপিণ্ড তো শুধু কলুর বলদের মত নিজের কাজ করে চলেছে।
এবার আসি আমার মূল ঘোটনায়। সময়টা হয়তো ২০০৯ কি ২০১০, ফাইনাল ইয়ার বা গ্র্যাজুয়েট, আমি তখন বারাসাতে থাকি। বাড়িতে কার একটা জন্মদিন ছিল ঠিক মনে নেই, আমি জন্মদিনের কেক কিনতে বেরিয়েছি। চাপাডালী মোড় থেকে টাকি রোডে ঢুকেই বাম দিকে বিজয়া সিনেমা, আর তার ঠিক পাশে কেকের দোকান ‘সুগার অ্যান্ড এস্পাইস’। দোকানটি খুবিই ছোট, সামনে কাচের দরোজা, ভিতরে কেক রাখা আছে কাঁচের শো-কেসে। দোকানটা এতই ছোট যে ভিতবে ২ জন খরিদ্দার থাকলে বাইরে থেকে কাঁচের দরোজা ঠেলে খোলার সময় ভিতরে থাকা খরিদ্দারের গায়ে লেগে যায়।
আমি আর হয়তো অন্য কেউ ভিতরে ছিলাম, কেক আমার জন্য প্যাক করা হচ্ছিল, আমি দাড়িয়ে চুপচাপ। হঠাৎ কাঁচের দরোজা খোলার শব্দ এলো, আর তার সাথে একটা মিষ্টি কণ্ঠস্বর,
“কাকু, একটু সরে দাঁড়াবেন!”
এই চারটি শব্দ মায়াবী কণ্ঠে শুনে আমার বুক ধড়াস ধড়াস করে লাফাতে লাগলো। আমি হতভম্ব হয়ে, কাঠের পুতুলের মত সরে দাঁড়ালাম। মেয়েটি সুন্দরী, আধুনিকা, daddy’s angel. আমি নিশ্চিত মেয়েটি বয়সে আমার থেকে বড়। দাদা বলতে পারতো কিম্বা একটু সরে দাঁড়াবেন বলতে পারতো? তা না সরাসরি কাকু ?
বাসে ট্রামে আমি দেখেছি, অনেক দিদি ও কাকিমারা (ধেড়ে মেয়ে) অল্প বয়সী কন্ডাকটর কে কাকু বলে ডাকে। খুব রাগ হয়, ওদের বাড়ি কি আয়না নেই ?
সঞ্জয় হুমানিয়া
ঔরঙ্গাবাদ, মহারাষ্ট্র ৪ মার্চ ২০১৪
★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★