Share

খেজুর রস, খেজুর গুড় আর মোয়া

খেজুর রস খেজুর গুড়, এ সব এখন আমার কাছে ইতিহাস। বহু বছর সাক্ষাৎ হয়নি। এই খেজুরের রস আর গুড় দেখলেই দাদিমার (ঠাকুমার) কথা মনে পড়ে যায়। তখন আমি খুব ছোটো, তবে সেই স্মৃতি স্থায়ী হয়ে গিয়েছে মনে। এত ছোটবেলার স্মৃতি কিভাবে স্থায়ী হয়েছে তা জানি না। স্মৃতিতে আছে, কোন এক শীতের সকালে আমাকে ঘুম থেকে তুলে মা সোয়েটার পরিয়ে দিয়েছে, হাতে নীল রঙের দস্তানা। ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরের শত ফুটিফাটা লাল রঙের বারান্দায় আমি এসে দাঁড়ালাম। বারান্দার এক ধারে পিতলের জগে ঠাণ্ডা খেজুরের রস রাখা আছে। কে যেন আমাকে একটি ষ্টীলের গ্লাসে সেই ঠাণ্ডা রস ঢেলে দিলো। আমি দস্তনা পরা দু হাত দিয়ে গ্লাস ধরে চুমুক দিতেই আমার দাতে খিল ধরে গেলো। উফ!! কি ঠাণ্ডা !!

ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ

ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ

শৈশবে দেখেছি, খেজুর গাছের বিশেষে এক অংশের পাতা কেটে ফেলে এক বিশেষ কৌশলে গাছের কিছুটা অংশ চেচে ফেলা হয়। তার পর এই চেছে ফেলা অংশে নিপুণ হাতে সরুসরু চ্যানেল কেটে একটু নিচে একটা কঞ্চির নল বসিয়ে দিতেন নাজির আলি। যত দূর মনে আছে নাম টি নাজির আলিই ছিল, নাম verify করার এখন কোন উপায় নেই। এই নাজির আলি আমাদের গ্রামের রস কালেক্টর। অর্থাৎ গাছ গ্রামের মানুষের, উনি গাছ কাটবেন, ভাঁড় বসাবেন আর যা রস হবে তা গাছের মালিকের সাথে ভাগভাগি। প্রথম বারের রস খাওয়ার উপযোগী হয় না, তা দিয়ে শুধু গুর হয়। দ্বিতীয় বা তৃতীয় বারে রস সুস্বাদু হয়।

শীতের সকালে উঠে দেখতাম বাড়ির ভিতরের উঠানে ঠাকুমা রস জ্বাল দিচ্ছে। কত সকালে নাজির আলি রস সংগ্রহ করে আমাদের দিয়ে যেত তা কোনদিন দেখিনি। বড় আয়তক্ষেত্রাকার উনুন, তার উপরে আয়তক্ষেত্রকার অ্যালুমিনিয়ামের কড়াই। এই কড়াইয়ে রস জ্বাল দিয়ে গুর তৈরি করতো। আমি উননের পাশে গিয়ে চুপচাপ ফুটন্ত রস দেখতাম। উননের পাশে দাঁড়ানোর আর একটি কারন গনগনে আগুনের তাপ। রস একটু গাড়ো হয়ে উঠলে ঠাকুমা একটি লম্বা বাসের তৈরি খুন্তি দিয়ে ক্রমাগত নাড়তে থাকতো।

ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ

গুড় হয়ে গেল, আয়তক্ষেত্রাকার সেই কড়াই থেকে গুর তুলে রাখা হতো মাটির ভাঁড়ে। চিটচিটে গুর সম্পূর্ণ কড়াইয়ের গা থেকে তোলা যেত না। ঠাকুমা তখন মুড়ি ঢেলে দিতো সেই কড়াইয়ে। তারপর হাত দিয়ে সেই মুড়ির গায়ে অবশিষ্ট গুড় মাখিয়ে কড়াই পরিষ্কার করতো। আমাদের জন্য মুড়ি গুড়ের মোয়া তৈরি।

ঠাকুরদা মারা যাওয়ার পর পর বাগান, ভিটেবাড়ি, গাছ সব ভাগ হয়ে গেলো। অংশীদাররা গাছ কাটতে শুরু করলো। আম বাগান কেটে বাঁশ বাগানে পরিণীত হল। কাঁটা পড়লো খেজুর গাছ, তাল গাছ, বেল গাছ, জাম গাছ। এখন আর খেজুর গাছ নেই, শীতকালে আর রসও খাওয়া হয় না। ঠাকুমা নেই আজ অনেক বছর হয়ে গেলো। স্মৃতি গুলো শুধু রয়ে গেছে, আর রয়ে গেছে অনেক মন খারাপ।

★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★

ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ