সব স্টেশনেই আপনি পাবেন এই লেবুজলের দোকান। বিশেষ করে বারাসাত, হাবরাতে আমি ডজনখানেক দোকান দেখেছি প্ল্যাটফর্মের উপরে। একটু গরম শুরু হলেই ব্যাঙের ছাতার মতো ছাতা খুলে গজিয়ে ওঠে এইসব দোকান। স্টেশনে স্টেশনে এইসব দোকানের আলাদা আলাদা নামও থাকে, যেমন — ‘ঝিক-ঝাক লেবুজল’, ‘চকচকে লেবুজল’ বা ‘তাজা লেবুজল’।
আমি প্রথম এই লেবুজলের স্বাদ পাই ২০০৯-১০ সালে। সেবার সদ্য চার বছরের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বনবাস থেকে ফিরেছিলাম। শহুরে জগতের সঙ্গে সবে যোগাযোগ হয়েছে। চার বছর নবাবদের জেলার কোনো একটা ছোট গ্রামের পাটখেতের মাঝখানে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সময় কাটিয়ে এসেছি। ছোটবেলা থেকে যতটুকু শহুরে ছোঁয়া পেয়েছিলাম, সবটুকুই এই চার বছরে ধুয়ে-মুছে সাফ করে বাড়ি ফিরেছিলাম। আমার জীবনযাপনের মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখতে পায় আমার বাড়ির লোকজন।
তা যাই হোক, বাড়ি ফেরার পর আমার তো ছুটি। আজ এখানে, কাল ওখানে ঘুরে বেড়ালাম বেশ কয়েকদিন। আমার বড়মাসির বাড়ি কিত্তিপুর গ্রামে। বারাসাত থেকে ট্রেনে মসলন্দপুর স্টেশন, সেখান থেকে অটো করে মগরা বাজার, তারপর সেখান থেকে হেঁটে, সাইকেলে বা ভ্যানে করে কিত্তিপুর গ্রাম। সেবার বড়মাসির বাড়ি আম খাওয়ার নিমন্ত্রণে যাচ্ছিলাম। সেই প্রথম লেবুজলের দোকান আবিষ্কার করলাম হাবরা স্টেশনে।
প্ল্যাটফর্মের উপরে রঙিন বড় ছাতা লাগিয়ে একটি লেবুজলের দোকান। ছাতার সিক থেকে ঝুলছে গোল গোল সাইনবোর্ড — লেখা আছে “ঝিকঝাক লেবুজল”। সাইনবোর্ড ঝুলছে, হাওয়ায় পাক খাচ্ছে, দুলছে, ঘুরছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে। কী অদ্ভুত দোকান, লেবুজল বিক্রি হচ্ছে! আমার কাছে এ দোকানটা অদ্ভুত লাগার কারণ আমি আগেই বলেছি — চার বছর বনবাস।
আমি কৌতূহলী দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম, কীভাবে লেবুজল হয়। ছোট্ট একটা টেবিল, উপরে একটা প্লাস্টিকের টুকরো সুন্দর করে বিছানো। টেবিলের চারধারে দু’ইঞ্চি করে কাঠের পাটা লাগানো, যাতে জল চারপাশ দিয়ে না গড়িয়ে পড়ে। টেবিলের এক কোণে প্লাস্টিকে একটা ছিদ্র, সেখান থেকে একটা পাইপ লাগানো — যেটা দিয়ে টেবিলের উপরে পড়া জল বেরিয়ে যেতে পারে।
টেবিলের সামনে লেবুর স্তূপ, একটু পিছিয়ে ডানদিকে মস্ত এক স্টিলের ঢাকনাওয়ালা ক্যান। গায়ে লাল কাপড় জড়ানো, কেন লাগানো জানি না। ঢাকনার উপরে একটা ছোট স্টিলের মগ। যেখানে লাল কাপড় একটু সরে গেছে, সেখানটায় বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা ক্যানের চকচকে শরীরকে ঝাপসা করে তুলেছে। বুঝলাম — এর ভেতরেই ঠান্ডা জল। ঠিক পাশেই একটা প্লাস্টিকের বালতি, তাতে গ্লাস ধোয়ার জল। অন্য পাশে সারি করে উল্টো করে রাখা কাঁচের গ্লাস। আর আছে একটা লেবু চিপে রস বার করার হাতযন্ত্র, বিটলবণের কৌটো আর ক্যাশবাক্স।
আমার মুখে জল চলে এল। মস্তিষ্ক ফিসফিস করে বলল, “এক গ্লাস খেয়ে ফেল।” আমি আর না করতে পারলাম না। নিজের অজান্তেই ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এল —
“দাদা, এক গ্লাস লেবুজল।”
যেমন বললাম, দোকানদার বেস্ট হয়ে পড়ল। প্রথমে একটা গ্লাস তুলে লোকদেখানো ধুল প্লাস্টিক বালতির জল দিয়ে। তারপর বিটলবণের কৌটো থেকে ছোট্ট একটা চামচে করে লবণ ঠকাস শব্দে গ্লাসে ফেলল। পরে একটা লেবু নিয়ে ছুরি দিয়ে কেটে রসবার হাতযন্ত্রে ঢুকিয়ে নিংড়ে ফেলল সমস্ত রস। এবার স্টিলের ক্যানের ঢাকনা তুলে মগ ডুবিয়ে জল এনে গ্লাসে ঢেলে দিল। তারপর আরেকটা খালি গ্লাস ওই জলভরা গ্লাসের উপরে উল্টো করে রেখে দুটোকেই হাতে তুলে বেশ করে ঝাঁকিয়ে নিচের গ্লাসটা এক বিশেষ কায়দায় আমার হাতে তুলে দিল।
লেবুজলে যে এত তৃপ্তি — সেবার প্রথম বুঝেছিলাম। এখন অনেকেই বলবেন, “আনহাইজেনিক, লেবুজল না খাওয়াই ভালো।” সব জানি, বুঝি — কিন্তু মন মানে না (মন মানে না — সুর করে পড়তে হবে)। ২০১৬ সালে মুম্বাই গিয়েছিলাম, সেখানেও দেখলাম লেবুজল বিক্রি হচ্ছে একইভাবে। কৌতূহলী হয়ে দেখলাম নিয়মও সেই একই। দোকানদারের সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিজেই বানালাম এক গ্লাস লেবুজল নিজের জন্য। এক সহকর্মী সেই ছবি তুলে দিয়েছিল — আজ সেই ছবিই স্মৃতিচারণের উপলক্ষ।
সঞ্জয় হুমানিয়া – বেঙ্গালুরু
২০ এপ্রিল ২০১৭



রূপ কথা
বিজয়া দশমীর রাতের গল্প
কালচক্র
শামুকের মুক্তি
অভিমানী বাবী
বৃষ্টির দিনে সেই প্রথম
ফেসবুকের অভিনন্দন পত্র
Gaighata Tornado 1983 | গাইঘাটা ঘূর্ণিঝড় ১৯৮৩ (চড়ুইগাছি টর্নেডো)