বহু বছর আগের কথা। লজ্জায় এত দিন কাউকে বলিনি। এখন আর আগের মতো লজ্জা করে না, কেমন একটা don’t care ভাব চলে এসেছে। আজ হঠাৎ মনে এলো, এবং কাউকে বলতে ইচ্ছে হলো। এই ঘটনা মনে পড়ার পিছনে অবশ্য আমার বই কেনার অন্য আর একটি ঘটনা আছে।
আমি এক নামকরা বড় লোকেদের ইস্কুলে পড়তাম। মধ্যবিত্ত হয়েও এই সুযোগ আমাকে দেওয়ার জন্য আমাদের সপরিবার কে অনেক ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। হয়তো তার সঠিক মূল্য আমি কোনোদিনই দিতে পারিনি।
স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে প্রায় এক দশক ধরে আমাকে বড়োলোকের অভিনয় করতে হয়েছে। আমি কোনো দিনই ভালো অভিনেতা নই, স্কুলে অনেক চেষ্টার পরেও বাৎসরিক অনুষ্ঠানে কোন দিন কোন নাটকে ছোট্ট একটি অভিনয়ের সুযোগ পাইনি। তবে বাস্তবে যা আমি না, তার অভিনয় আমাকে করে যেতে হয়েছে ইস্কুল জীবনে। সহপাঠীরা অল্পস্বল্প হয়তো বুঝতে পারতো আমার অভিনয়। আমি তাদের সকলের কাছে কৃতজ্ঞ। তারা আমাকে কোনোদিন এটা বুঝতেই দেয়নি যে তারা আমাকে বুঝে ফেলেছে।
হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধু পেয়েছি স্কুল জীবনে। নাহ, আজ তাদের নাম নেবো না। যদি কোনো দিন তারা আমার এই লেখা পড়ে, তাহলে তারা নিজেই বুঝে যাবে। সেদিন এই লেখা স্বার্থক হবে।
ঠিক মনে নেই, তখন মনে হয় eight বা nine এ পড়ি। কলকাতায় তখন সবে মাত্র Zenith PCর রমরমা বাজার। কম্পিউটার আর তার সঙ্গে টিভি। আমার এক বন্ধুর বাড়িতে এই Zenith PC এলো। আমার বাড়িতে তখনো সাদা কালো টিভি, সঙ্গে বুকের পাঁজরের হাড়ের মতো অ্যান্টেনা। একজন ছাদে, একজন বাড়ির উঠোনে, আর একজন টিভির সামনে। ছাদের উপর যে থাকবে সে না না ভাবে না না অ্যাঙ্গেলে অ্যান্টেনা ঘোরাবে। টিভির সামনে যে থাকবে সে টিভির কান মোড়া দিয়ে ছবি পরিষ্কার করার চেষ্টা করবে। ছবি পরিষ্কার হলেই সে চিল্লে বলবে এবং সেই একই কথা বাড়ির উঠোনে যে দাঁড়িয়ে থাকবে সে রিলে করে ছাদের জন কে জানিয়ে দেবে। আমি এখানে সেই সংলাপের কিছু উদাহরণ দিয়ে দিচ্ছে।
১) হয়েছে…. হয়নি…. হয়েছে…. হয়নি….
২) আগে যেমন ছিল, সেদিকে ঘোরা আবার…
৩) হ্যা, ওই ভাবে ধরে থাক, নাড়াস না…
৪) না না হচ্ছে না, হচ্ছে না…
৫) আর একটু ঘোরা, সামান্য একটু…
যাই হোক ওসব বাজে কথা না বোকে আসল ঘটনায় আসা যাক। আমি এদিকে মাঝে মাঝে নানা অজুহাতে ওই বন্ধুদের বাড়ি যেতে শুরু করলাম রঙিন টিভি আর কম্পিউটার দেখতে। ও হয়তো বুঝতে পারতো, তবে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করতাম অভিনয় করার। বন্ধুর বাড়ি মন্ডলগাঁথি। আমরা টিউশন পড়তে বা অন্য কাজে মাঝে মধ্যেই বারাসতের বিভিন্ন জায়গায় এক সাথে যেতাম। আমি সাইকেলে করে বারাসাত আর বন্ধুটি বামুনগাছি থেকে ট্রেনে বারাসাত আসতো। তার পর আমার সাইকেলে সারা বারাসাত চোষে বেড়াতাম। একবার ওর একটা নতুন MP3 CD কেনার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। যথারীতি আমরা পৌঁছে গেলাম সেযুগের নকল ক্যাসেট ও CDর আখড়ায়। কোর্টের মাঠে ১৫ টাকায় সে যুগে MP3 CD বিক্রি শুরু হয়েছে সবে। অনেক বাছাবাছির পরে বন্ধু একটি উদিত নারায়ণের MP3 CD কিনে ফেললো। এই ছোট্ট সময়ের মধ্যে আমারও একটি CD কিনতে ইচ্ছে হোলো। আমার বাড়িতে তখন কম্পিউটার দূরের কথা, CD প্লেয়ারও নেই। আমি পছন্দ করে ফেললাম একটি কিশোর কুমার হিটস। বিশেষ এক কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে বন্ধু জিজ্ঞাসা করলো আমাকে,
আচ্ছা! তোর তো কম্পিউটার বা CD player নেই, তুই CD নিয়ে কি করবি?
ছোটবেলা থেকেই আমি সব জিনিষের ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারি, শুধু পরীক্ষার খাতায় গোল্লা। বন্ধুর সামনে আমি এক ব্যাখ্যার কেল্লা খাঁড়া করলাম। আমার ব্যাখ্যার সারাংশ এই যে, – আজ হয়তো কম্পিউটার বা CD player নেই, তবে ভবিষ্যৎ বলেও তো কিছু একটা আছে। কোন একদিন তো বাড়িতে কম্পিউটার বা CD player আসতেই পারে। আজ চাবুক কিনে রাখছি, এতে ঘোড়া কেনার motivation পাবো। এই ব্যাখ্যা শুনে বন্ধুও মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক”।
স্থান, গীতা মার্কেট বারাসাত। বারাসাতের মানুষ সবাই চেনে এই গলি। এখানে পাঞ্জাবীর ইলেকট্রনিক্স দোকান অতি পরিচিত। আমি মাঝেমধ্যে এই দোকানে আমার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সন্তোষের ক্যাসেট প্লেয়ার কে ঠিক করাতে নিয়ে যেতাম। একবার কি একটা কাজে দোকানে গিয়ে দোকানের সামনেই অপেক্ষা করছি। একজন ভদ্রলোক পাঞ্জাবীর দোকানে এসে একটি বিশেষকোম্পানির বিশেষ মডেল উল্লেখ করে CD player এর একটি রিমোট চাইলো। পাঞ্জাবী একটি সুদৃশ্য রিমোট তাকে দেখিয়ে বলল, এটা universal CD player রিমোট, এটা সব CD player এ support করবে। লোকটি কয়েকটি বাক্যব্যয় করে দাম মিটিয়ে চলে গেলো। এদিকে আমার মনে ঢেউ উঠেছে। Universal CD player রিমোট অর্থাৎ যেকোনো CD playerএ সাপোর্ট করবে। পাঞ্জাবী কাকু কে বললাম, আমার CD player এর রিমোট কাজ করছে না। পাঞ্জাবী দ্বিতীয় একটি রিমোট আমার হাতে দিয়ে আবার বলল, Universal CD player রিমোট, এটা সব CD player এ support করবে। মনে মনে গুনে নিলাম, দুটো জিনিষ কেনা হোলো, এবার CD player কিনলেই হোলো। চাবুক কেনা হলে, একদিন ঠিক ঘোড়া কেনা হবে।
জীবনে কত যে এমন ঘটনা আছে। এখনো এই ছেলেমানুষি কাজ করে আমার মধ্যে। কিছু স্বপ্ন পুরন হয়, কিছু স্বপ্নই থেকে যায়। তবে আমি আশাবাদী মানুষ, আশা ছাড়ি না। জীবনে প্রথম বাইক কেনার আগে, আমার ঘরে তিন চারটি হেলমেট জমে গিয়েছিলো। বাড়িতে একটা ছোট্ট লাইব্রেরি হবে, তাই প্রায় এক দশক ধরে বই কিনে চলেছি। ছোটছোট স্বপ্ন নিয়েই মানুষ বেচে থাকে। স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তর হলে ভালো, আর না হলে নচিকেতার ভাষায়-
যখন সময় থমকে দাঁড়ায়
নিরাশার পাখি দুহাত বাড়ায়
খুঁজে নিয়ে মন নির্জন কোন
কি আর করে তখন
স্বপ্ন স্বপ্ন স্বপ্ন
স্বপ্ন দেখে মন।
★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★