আমি থাকি ব্যাঙ্গালোরের এক প্রান্তে, আর আমার এক কলেজের সহপাঠী বন্ধু থাকে অন্য প্রান্তে। আমাদের মাঝে দূরত্ব মাত্র ২৪ কিলোমিটার, তবে মনে হয় মনোভাবে দূরত্ব আরও কম। সহপাঠী বন্ধুর নিমন্ত্রণ পেলেই যেন আমার গায়ে জ্বর আসে। ২৪ কিলোমিটার যাওয়া, আবার ২৪ কিলোমিটার ফিরে আসা—সে কি মুখের কথা!

সহপাঠীর সহধর্মিনীর জন্মদিন উপলক্ষে হঠাৎ করেই নিমন্ত্রণ এসে গেল। এবার যেতেই হবে! বন্ধুর নিমন্ত্রণে স্পষ্ট নির্দেশ—মিস করা চলবে না। আমি আর আমার রুমমেট সুমন, দুজনেরই নিমন্ত্রণ। স্নান করে, তৈরি হয়ে আমরা দুজনে ‘দুগ্গা দুগ্গা’ বলে রওনা দিলাম বন্ধুর বাড়ির দিকে। এবার ২৪ কিলোমিটারের যাত্রা, মাথায় দুটো হেলমেটের মুকুট, আর বাহন হিসেবে আমাদের নীল রঙের স্কুটি।

আমি বেশিক্ষণ হেলমেট পরে থাকলে মাথার ভিতরে কুটকুট করে। সুমনকে বহুবার জিজ্ঞাসা করেছি, তার হয় কি না—সে নাকি বলে, “না, আমার হয় না!” যাই হোক, পেট্রোল ভরিয়ে আবার আমরা যাত্রা শুরু করলাম।

বেঙ্গালোরে হেলমেট মাথায় থাকলে আর গাড়িটা নতুন হলে পুলিশ বেশিরভাগ সময় ধরেই নেয় আপনার কাগজপত্র ঠিক আছে। পুলিশ আপনাকে ছোঁবে না। বেঙ্গালোরে কিছু অদ্ভুত ধরনের বাইকার দেখা যায়—চাচা বাইকাররা হেলমেটের বদলে সাদা টুপি পরে চালান। শীতকাতুরে বাইকারদের দেখা যায় সব ঋতুতেই শীতের জ্যাকেট পরে থাকতে। আর বড়লোক বাইকাররা বিরল কোম্পানির বাইক চালান, যেগুলোর গঠন, আওয়াজ এবং দাম—সবই সাধারণের বাইরে।

Cubbon Park রোড, যা রাজভবনের কাছে, সেখানে কয়েকটি সিগন্যাল আছে যেখানে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হয়। এই সিগন্যালেও কিছু ফেরিওয়ালা গাড়ির যাত্রীদের কাছে নানা জিনিস বিক্রি করেন—ফোন হোল্ডার, AUX কেবল, হেডফোন, কলম, গাড়ির কাচ মোছার কাপড়, ফুলের তোড়া, বাচ্চাদের খেলনা, সানগ্লাস ইত্যাদি।

ধরুন আপনি সিগন্যালের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, নিরবে এক ফেরিওয়ালা আপনার পাশে এসে সানগ্লাস দেখাতে শুরু করবে। বেশিরভাগই নামিদামি ব্র্যান্ডের নকল। দাম চাইবে ২০০-৩০০ টাকা। আপনি দর কষাকষি করবেন, হয়তো সিগন্যাল খুলে যাবে আর আপনি কিছু না নিয়েই চলে যাবেন, অথবা তাড়াতাড়ি কিনে নেবেন।

গতবার আমিও একটি ‘RoyBon’ নামের সানগ্লাস কিনেছিলাম মাত্র ৮০ টাকায়। এবারও সিগন্যালের সামনে দেখি, এক ফেরিওয়ালা আর দুই স্কুটিসওয়ারের মধ্যে দর কষাকষি চলছে। স্কুটির দুই আরোহীর বয়স আনুমানিক ২১-২২। হঠাৎ সিগন্যাল ছেড়ে দেয়, সবাই হৈচৈ করে রওনা দেয়। ওই স্কুটির দুই আরোহীর চোখে সানগ্লাস, আর পিছনে দৌড়াচ্ছে ফেরিওয়ালা। মুহূর্তে স্কুটিটা অদৃশ্য হয়ে গেল। ফেরিওয়ালা দৌঁড়ে প্রায় ১৫০-২০০ মিটার এসে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে।

আমি কৌতূহলবশত সুমনকে বললাম থামতে। ফেরিওয়ালাটি আমাদের দুহাত পেছনে দাঁড়িয়ে, মুখ সামনের দিকে, ডান হাতটা উপরে তুলে রেখেছে। তার চোখেমুখে বিরক্তি আর অসহায়তার মিশ্র প্রতিচ্ছবি। আমাদের দেখতে পেয়ে সে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বলল, “সাহাব, দো চশমা লেকে ভাগ গায়ে দো লন্ডে।” ফেরিওয়ালার পোশাক দেখে মনে হল সে রাজস্থানের মানুষ। হয়তো সদ্য এসেছে বেঙ্গালুরুতে, জীবিকার খোঁজে। এই ফেরির ব্যবসাটাও হয়তো তার কাছে নতুন, তাই ব্যবসার কৌশলগুলো এখনো আয়ত্তে আনতে পারেনি।

লোকটি মুখ দিয়ে একটা দীর্ঘ “ছাঃ…” শব্দ করে ধীরে ধীরে ফিরে গেল পেছনের সেই সিগন্যালের দিকে।

সঞ্জয় হুমানিয়া
২৩ জুলাই ২০১৮, বেঙ্গালুরু, ইন্ডিয়া

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *