আজ খুব মনে পড়ছে ছোটবেলার গ্রামের ফেলে আসা দিনগুলো। একান্নবর্তী পরিবার, কোনো অভাব নেই। মা, আব্বা, কাকা, কাকিমা, দিদি, আমি আর বড় আদরের দাদিমা (ঠাকুমা)। দাদি আদর করে আমাকে “সঞ্জু” বলে ডাকতো। ঠাকুমার ভাইয়ের নাম ছিল “শাহাদাত”, মাঝেমাঝে আদর করে আমাকে বলতো, “এটা আমার শাহাদাত ভাই।” হয়তো ঠাকুমা তার ভাইকে খুব ভালোবাসতেন। তখন ছোট ছিলাম, এত কিছু বুঝতাম না। ঠাকুমার সাথে আমার যে সব মধুর স্মৃতি, সবই ওই ৫/৬ বছর বয়স পর্যন্ত। এই সময়ের অনেক স্মৃতি আজও তাজা হয়ে আছে আমার মনে।

ঠাকুমা ভালোবাসতেন গাছপালা আর বাড়িতে গরু, মুরগি, হাঁস আর কুকুর পুষতে। বাড়ির ভিতরেই ছিল পেয়ারা গাছ, পেঁপে গাছ, কুল গাছ। খিড়কির দরজা দিয়ে বাইরে বেরলেই জামরুল গাছ, বেল গাছ, আম গাছ, নারকেল গাছ, কুল গাছ। ছোটবেলায় কোনোদিন পেয়ারা, আম, জাম, কাঁঠাল, জামরুল, পেঁপে, কুল, লিচু কিনে খেতে হয়নি, সব বাড়িতেই সহজলভ্য ছিল। ছোটবেলায় কাঁঠাল আর পাকা পেঁপে খেতে খুব বিরক্ত লাগতো—বিশেষ করে পাকা পেঁপে। ছোটবেলায় দেখেছি, বাড়ির গাছে প্রায় এক হাত লম্বা বড় বড় হলুদ রঙের পেঁপে ঝুলছে। আমাদের খাওয়ার আগে পাখি পাকা পেঁপে খাওয়া শুরু করে দিতো।

আজ প্রায় তিন দশক পরে এখন আর পেঁপে খেতে বিরক্ত লাগে না, বরং খুব ভালো লাগে। ছোটবেলায় গাছের পেঁপে পাড়িয়ে ঠাকুমা কত সাধাসাধি করতেন খাওয়ানোর জন্য। খেতাম নামমাত্র, না খাওয়ার মতো। কেন ভালো লাগতো না, জানি না। এখন যখন বাজার থেকে পাকা পেঁপে কিনে আনি, আর ঠিক খাওয়ার সময় আমার সেই তিন দশক আগের স্মৃতি মনে পড়ে। মনে মনে ভাবি, যে ছেলে এত অপছন্দ করতো, সে আজ এত তৃপ্তি করে কিভাবে পাকা পেঁপে খায়? ভাবতে ভাবতেই নিজে নিজে অবাক হই। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। এ তৃপ্তি শুধু পাকা পেঁপে খাওয়ার নয়, পাকা পেঁপে আর ছোটবেলার স্মৃতির। সত্যি বলতে এখন একটু বেশিই পাকা পেঁপে খাই—হয়তো সেই পুরনো স্মৃতির টানে।

আমাদের মাঝে মাঝে অনেক কিছু যা খুবই সহজলভ্য বা আমাদের সঙ্গে থাকে, তার মূল্য আমরা বুঝতে পারি না। সময়ের চক্রে যখন সেটি ফুরিয়ে যায় বা হারিয়ে যায়, তখনই তার প্রকৃত মূল্য বুঝতে পারি। যেমন আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সেই পুরনো দিনের বাড়ির গাছের হলুদ রঙের পাকা পেঁপে, আর তার সঙ্গে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি ঠাকুমার আদর।

সময় থাকতে সময়কে আর আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সব কিছুকে মূল্য দিতে শিখতে হবে। সব হারায় বারবার, কিন্তু সময়ের হার অমূল্য।

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *