সপ্তাহে দুদিন হাট বসে, বিষুদবার (বৃহস্পতিবার) আর রোববার (রবিবার)। নগেন মুচি হাটের এক কোনে জুতো সেলাই করে। সাধারণত গ্রামের বুড়ো বটতলায়, চায়ের দোকানের পাসেই একটা ছেড়া কালো ছাতা খুলে জুতো সেলাই করে। শুধু মাত্র এই দুদিন সে হাটে বসে। এই দুদিনে যা রোজগার হয়, সারা সপ্তাহে সে রোজগার হয় না। সত্যি বলতে সপ্তাহের অন্য দিন তেমন রোজগারই হয় না। গ্রামে তো রোজ রোজ লোকের জুতো বা চটি ছিঁড়ে যায় না, আর ছিঁড়ে গেলেও হয়তো সেপ্টিপিন কিম্বা নগেনকেই বিনিপয়সায় সেলাই করে দিতে হয়। মাঝে মধ্যে দুএকটা খদ্দেরও জুটে যায় বটে, যারা পয়সা দিয়ে জুতো সেলাই করিয়ে নেয়।
নগেন সারাদিন চায়ের দোকানের সাদাকালো টিভি দেখে। কখনো হিন্দি গান, বাংলা খবর, রাতে বাংলা কূটনৈতিক সিরিয়াল, এই নিয়েই নগেনের সারা দিন কেটে যায়। দিনে দুবার খাওয়ার জন্য বাড়ি ফেরে সে, দুপুরবেলা আর রাতে। নগেনের জীবনে, সকাল হয়, সন্ধ্যা হয়, রাত হয়, আবার সকাল হয়। আমাদের কাছে যেটা বেজায় একঘেয়ে। নগেনের এসব কিছু মনে হয় না। সে ভাবে সকলের জীবনই হয়তো এমন, সে তো আর সাহিত্য পড়েনি। সে কি করে জানবে বিরহ কি? একাকীত্ব কি? বা নিস্তরঙ্গ জীবন মানে ঠিক কি? সে তো শুধু জানে, জীবন মানে জি বাংলা। নগেনের ছেলেপিলে হয়নি, মাত্র দুজনের সংসার। দুইদিন হাটে যা রোজগার হয়, ওতেই টেনেটুনে দুটো পেট চলে যায়। সংসারে অভাব নেই, কারন ওদের দুজনের চাহিদা কম। কোন রকমে দিন কেটে গেলেই হয়।
সামনে ভোট, এ খবর সে আগেই শুনেছে টিভিতে। এ গ্রামে ভোট একটা উৎসব, ভোটের দিন গ্রামের ইস্কুলের সামনের রাস্তায় মেলা বসে। আর পাঁচটা পূজো বা উৎসবে যেমন মেলা বসে, ঠিক ভোটের দিনও এখানে মেলা বসে। সারা বছর বোঝাই যায় না গ্রামের মেম্বার কে বা পঞ্চায়েত প্রধান কে। ঠিক এই সময়ই এই সব মানুষের পরিচয় উঠে আসে। এইতো সেদিন সন্ধ্যায় চায়ের দোকানের তক্তপোষে বসেই তর্ক বেঁধে গিয়েছিলো, যে আমাদের মেম্বার কি গোবর্ধন খাঁড়া নাকি বাসন্তী মাল ? অনেক তর্কতর্কির পর গ্রামের পোষ্ট মাস্টার কে রাস্তা দিয়ে সাইকেলে যেতে দেখে সবাই তার উপরে ঝাপিয়ে পড়েছিলো। শেষমেশ জানা গেলো যে আগে গোবর্ধন খাঁড়া ছিল, এখন বাসন্তী মাল হয়েছে। সত্যি বলতে এই গ্রামের এই সাদাসিধে মানুষগুলোর কোন মাথা ব্যথা নেই কে মেম্বার বা কে পঞ্চায়েত প্রধান।
সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ কয়েকটা চেনা মুখ অনেকদিন পরে গ্রামে দেখা গেলো। সকলে সাদা সুতির হাফ হাতা জামা গায় আর সাদা প্যান্ট পরা। একটু বয়স্ক যারা, তার সাদা কুর্তা। নগেন এদের মুখ চেনে, প্রতিবার ভোট মেলার আগে এরা গ্রামে আসে। এরা কত ভালো ভালো কথা বলে, কত সুন্দর করে কথা বলে, সকলের সাথে নমস্কার করে হাট জোড় করে কথা বলে। গত বার ভোট মেলার আগে এরাই এসেছিল, কত ভালো কথা বলেছিল, কত সপ্ন দেখিয়েছিল। এমন সব জিনিসের কথা বলেছিল, যেসব নগেন বা গ্রামের লোক কোন দিন ভেবে দেখেনি। ধরুন, গ্রামের রাস্তা পাকা হবে, ঠিক যেমন গ্রাম থকে ২ মাইল হেটে গেলে পাকা রাস্তা, ঠিক তেমন, যেখানে হাট বসে। রাস্তার ধারে কারেন্টের পোলে সাদা রড লাইট জ্বলবে, যার বিল গ্রামের লোক কে দিতে হবে না। গ্রামে স্বাস্থ্য কেন্দ্র হবে, ঠিক যেমন হাটের পাশে একটা ভাঙ্গাচোরা হাসপাতাল আছে। এমন নানা ধরনের ভালো ভালো কথা এরা প্রতিবার এসে বলে যায়। কিন্তু এসব ছাড়াই তো গ্রামের লোক বেঁচে আছে, এসব নেই বলে তাদের তো কোন কষ্ট নেই! বাবুরা যখন এসব বললো, তখন যেন মন কেমন করে, এসব থাকলে তো ভালই হয়। নগেনের আবার মাঝে মাঝে ভয় লাগে, এই সব বাড়তি সুযোগ সুবিধা নিতে আবার টাকা লাগবে না তো? নগেন মনে মনে ভেবে নিলো, যদি টাকা লাগে তবে সে এসব সুবিধা নেবে না। বেকার টাকা নষ্ট, আর টাকা থাকলে তো নষ্ট করবে। এটুকু ভেবেই সে নিশ্চিত হলো।
সেদিন সন্ধ্যার আঁধারে গ্রামের একমাত্র মুচির বাড়িতে কয়েকজন বাবু এলেন। মাটির দেওয়াল আর টালির ছাউনির ঘরে কেউ ঢুকলেন না, বাইরে থেকেই চাপা গলায় নগেনের নাম ধরে ডাকলেন তারা। নগেনকে কেউ এই ভাবে ডাকে না, নগেন গ্রামের অতি সামান্য লোক। বাইরে এসে নগেন তো অবাল, এ বাবুরা তার বাড়িতে? কি ব্যাপার ? মনে মনে সে খুব অপ্রস্তুত বোধ করলো। বাবুদের নমস্কার করা জোড় হাট দেখে নগেনের আরও ভয় লাগলো, নগেনেকে কেউ নমস্কার করে না, সে তো জুতো সেলাই করে খায়, তাকে কেউ কেন নমস্কার করবে? নগেনও হাত জোড় করে সামেন দাড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে বাবুদের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবুরা গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলতে শুরু করলেন –
“শোন নগেন, কাল শহর থেকে আমাদের দলের বড় সাহেবরা আসবেন। তোদের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করবে”
এই শুনে তো নগেনের রক্ত আর হাড় দুটোই হিম হয়ে গেলো। এবার কি হবে? খাওয়ানো দুরের কথা, বাবুদের বসতে দেওয়ার যায়গা নেই নগেনের কুঁড়ে ঘরে।
বাবুরা আবার বলতে শুরু করলো, –
“কাল সকালে আমাদের দলের লোকেরা সব ব্যবস্থা করে দিয়ে যাবে, তুই শুধু সামনে থাকবি, বাবুদের খাওয়াতে সাহায্য করবি”
নগেনের একটু ভয় কমে গেলো, যাক তাহলে এই বাবুরাই বাজার ঘাট করে দেবে হয়তো, শুধু বউ কে দিয়ে রান্না করাতে হবে। বাবুরা আবার শুরু করলো, –
“কাল দুপুরের খাওয়া এখানে তোর বাড়িতে হবে, সকালে সব খাবার দাবার আর জলের বোতল আমাদের ছেলেরা দিয়ে যাবে তোদের বাড়ি। তুই আর তোর বউ সেগুলো থালা সাজিয়ে সাহেবদের খেতে দিবি”
নগেন এবার হাঁফ ছেঁড়ে বাঁচলো। যাক বউকে কিছু করতে হবে না, সব হয়তো হোটেল থেকে নিয়ে আসবে। যাবার আগে, বাবুরা আর একটা কথা বলে গেলো, এটা নগেন কেই করতে হবে। সাহেবরা কলাপাতায় ভাত খাবেন, তাই এই টুকু নগেন কে ব্যবস্থা করতে হবে। এটা শুনে তো নগেন মহা খুশি। কলাপাতা তে তো টাকা লাগে না, বাগানে গেলেই পাওয়া যায়। সে রাতে নগেনের মেজাজ ফুরফুরে। শোয়ার পরে বউকে বেশ ইয়ার্কির চলে বললো-
“কাল তোর তো বেশ ভালোমন্দ খাওয়া হবে রে, সাহেবদের জন্য কত খাবার আসবে হোটেল থেকে”
সকাল থেকেই গ্রামে উৎসবের রং লেগে গেলো হঠাৎ। রাস্তার ধারের নারকোল গাছে, কাঁঠালগাছে, কারেন্টের পোলে রাজনৈতিক পতাকা ঝুলছে। সবাই রাস্তার মোড়ে, চায়ের দোকানে জটলা করছে। নগেন কে দেখে আজ সবাই তার দিকে বেশ হাসি হাসি মুখ করে তাকাচ্ছে, এমন তো কোন দিন হয়নি। চায়ের দোকানের পাশে নিজের ছাতা খুলে যখন দোকান খুললো, চায়ের দোকানদার হাসতে হাসতে বললো,
“তোমার তো এখন ব্যাপারই আলাদা, নগেন! বড় বড় লোক তোমার বাড়ি আজা আসবে”
নগেন পাল্টা কি বলবে না বুঝতে পেরে ফ্যালফ্যাল করে হেসে দিলো। দুপুরের আগেই ১০ – ১২ প্যাকেট খাবার, ঠাণ্ডা জলের বোতল চুপিচুপি নগেনের বাড়িতে চলে এলো। কথা মত নগেন কলাপাতা কেটে এনে রেখেছে বাড়িতে। সাহেবদের বসার জন্য পাশের বাড়ি থেকে মাদুর ছেয়ে এনে রেখেছে নগেনের বউ।
দুপুর দুটোর দিকে মাইকে ভোটের প্রচার করতে করতে বাবুরা আর বড় সাহেবরা এলেন গ্রামে। গ্রামের লোক মজা দেখার জন্য ভিড় জমিয়ে ফেললো। সে প্রায় সব মিলিয়ে ১০-১৫ টা গাড়ি, গ্রামের মাটির রাস্তার ধুলো ওড়াতে ওড়াতে মোড়ের মাথায় এসে থামলো। এখান থেকে নগেনের বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি যাবে না, হেটে যেতে হবে। একে একে সবা গাড়ির দরোজা খুলে গেলো, বাবু আর বড় সাহেবরা নমস্কারের ভঙ্গিতে নেমে এলো। সঙ্গে সঙ্গে পার্টির স্লোগান শুরু, সাংবাদিক ফ্ল্যাশ মেরে ছবি তোলা শুরু। সারা গ্রামের লোক আজ নগেনের বাড়ি দেখতে এসেছে। ১০ – ১২টা পাত পড়লো। সাহেব আর বাবুরা ধার করে আনা মাদুরে হাঁটু ভাঁজ করে বাড়ির উঠানেই বসে পরলেন, এদিকে সাংবাদিকরা ছবি তুলেই চলেছে। নগেন আর নগেনের বউ সঙ্গে পার্টির কয়েকজন ছোকরা পরিবেশন করে খাওয়ালেন। খাওয়ার শেষে সাংবাদিকদের সামনে একটা ছোট্ট ভাষণ দিয়ে দিলেন বাবু আর সাহেবরা, তারা নাকি খুব তৃপ্তি করে খেয়েছেন নগেনের বাড়িতে। নগেন খুব সুন্দর খাওয়ালেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সব শেষে একটু ভোটের প্রচার হল, কোথায় কোন চিহ্নে ভোট দিতে হবে সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়া হল। এদিকে গ্রামে একটা খবর ছড়িয়ে পড়লো, আজ সন্ধ্যায় টিভিতে নগেনকে দেখাবে।
বাবুরা খাবার নিয়ে এলেন, নগেনের বাড়িতে বসে খেলেন, সাংবাদিক ছবি তুললেন। নগেন আর তার বউ কিন্তু সে দুপুরে অভুক্তই থেকে গিয়েছিলো। তারা যেটা ভেবেছিল, তেমন মটেই হয়নি। হোটেলের একটু ভালো খাবার আর ঠাণ্ডা জল শেষে আর কুলিয়ে ওঠেনি। বাবু আর সাহেবদের দিতে দিতেই শেষ। নগেন আর তার বউয়ের প্রাপ্তি এই টুকুই, সন্ধ্যায় নিজেদেরকে টিভির খবরে দেখালো। দেখানো হল যে রাজনৈতিক দলের এক অংশ ভোটের প্রচারে বেরিয়ে, মধ্যাহ্ন ভোজন করেছে এক গরীব গ্রামবাসীর বাড়িতে। নেতারা খুবই তৃপ্তি করে খেয়েছেন এবং গ্রামবাসী কে ধন্যবাদ দিয়েছেন।
গ্রামের লোক বেশ কয়েকদিন এই নিয়ে আলোচনা করলো। সবাই ভেবেছিল সেদিন নগেন আর নগেনের বউ অনেক ভালোমন্দ খেতে পেয়েছিলো। রাস্তা ঘাটে অনেকেই ইয়ার্কি মেরে জিজ্ঞাসা করেছিল,
“কি রে, কি কি খেলি সেদিন বললি না তো? আমরা তো আর খেতে পেলাম না, তা না হয় তোদের মুখ থেকেই একটু শুনি বাপু!”
লজ্জায় নগেন আর তার বউ কেউই সেদিনের অভুক্ত থাকার গল্প কাউকেই বলেনি। কিই বা বলবে, বললে কি কেউ বিশ্বাস করবে? যেখানে টিভিতে দেখিয়েছে নগেনের বাড়ি সেদিন ভোজ হয়েছে, আর তারাই অভুক্ত ছিল? কেউ বিশ্বাস করবে না। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের কাছে এই টিভি একটি আলোর বিন্দু। এই টিভিতে নিজেকে দেখা কি কম ব্যাপার? হোক না সে খালি পেটে!!
সঞ্জয় হুমানিয়া
বেঙ্গালুরু – ৮ই মে ২০১৮
★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★