ভাগাড়-কাণ্ড যেন আমার মনে আরেকটা পুরনো স্মৃতিকে উসকে দিলো। এই লেখার পিছনে আমার কোনো আলাদা উদ্দেশ্য নেই। অনেক পুরনো ঘটনা, প্রায় ভুলে যাওয়া একটা স্মৃতি আবার যেন তাজা হয়ে উঠলো এই ভাগাড়-কাণ্ডের সূত্রে।
তখন আমি বেশ বড়, কৈশোর পেরিয়ে হঠাৎ যেন দ্রুত বড় হয়ে উঠতে চাইছি। সম্ভবত ক্লাস নাইনে বা টেনে পড়ি, ঠিক মনে নেই।
সেদিন বাড়িতে কিছু অতিথি এসেছিলেন, কে বা কারা সেটা স্পষ্ট মনে নেই। কিন্তু ঘটনার মুহূর্তটা স্পষ্ট মনে আছে, আর কারা কারা জড়িয়ে ছিল, তাও মনে আছে। ঘটনার প্রধান চরিত্র আমি নিজে, দ্বিতীয় চরিত্র আমার বড় মাসির ছোট ছেলে—আমার মাসতুতো ভাই বকুল, তৃতীয় চরিত্র মুরগির দোকানদার আর চতুর্থ চরিত্র আমার বাবা।
সকাল সকাল সবজি বাজার করা হয়ে গিয়েছিল, বাকি ছিল মুরগির মাংস। ধর্মীয় রীতি হোক বা বহুদিনের অভ্যাস, আমাদের বাড়িতে বাইরে থেকে কাটা মুরগির মাংস আনা হতো না। গ্রামে থাকতে দেখেছি, বাড়ির দেশি মুরগি ঠাকুমা বা মা নিজে ধর্ম মেনে কাটতেন। বারাসাতে আসার পর দেশি মুরগির জায়গা নিল পোলট্রি মুরগি, আর কাটার দায়িত্ব পড়লো কাকার ওপর।
সেদিন বাবা আমাকে মুরগি কিনে আনার দায়িত্ব দিলেন। আমি একা যেতে চাইছিলাম, তাই সঙ্গে পাঠানো হলো বকুলকে। দু’জনেই সাইকেল চালাতে পারতাম। দুটো সাইকেল আর একটা বাজারের থলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
যশোর রোড ধরে সদর হাসপাতাল, তারপর টেলিফোন অফিসের পাশ দিয়ে ডান দিকে—কোর্টের মাঠের পাশ দিয়ে পৌঁছে গেলাম বারাসাত বড় বাজারের মুরগির দোকানে। দরদাম করে একটা গোটা মুরগি কিনলাম। দোকানদার পাটের ছোট দড়ি দিয়ে মুরগির পা বেঁধে অদ্ভুতভাবে আমাদের থলের মধ্যে সেট করে দিলো। মুরগির মাথা থলের বাইরে সামান্য উঁকি মারবে, মাঝে মাঝে ডাকবে।
এই ডাকটাই আমার কাছে ছিল একটা ইন্ডিকেটর—মুরগি এখনো বেঁচে আছে। আমরা গল্প করতে করতে ফিরছি। শুরুতে খেয়াল রেখেছিলাম, মুরগি ডাকছে তো? পরে গল্পে এমন মজে গেলাম যে ভুলেই গেলাম থলেতে মুরগি আছে—আলু পটল নয়!
হাসপাতাল পার হতেই ঘটে গেল সেই দুঃখজনক ঘটনা।
যারা সাইকেলে বাজার করেন, তারা জানেন—বাজারের থলে সাধারণত তিন রকমের হয়—কাপড়ের, নাইলনের আর প্লাস্টিকের (সারের বস্তা কেটে বানানো)। আমাদের থলেটা ছিল তৃতীয় ধরনের—মুরগি আনার নির্দিষ্ট থলে। কারণ এই থলেতে মুরগি সাধারণত হেগে দিত, সেটা বদমায়েশি করে করত না, প্রকৃতির ডাকে করত।
খালি থলে সাধারণত সাইকেলের বাম হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে রাখা হয়, সেটা হাওয়ায় দুলতে থাকে। মাঝে মাঝে তা সামনের চাকা আর ফর্কের মাঝে ঢুকে যেতে পারে। কিন্তু থলে যদি পুরো ভর্তি থাকে, তবে সেই সম্ভাবনা থাকে না। বিপদ হয় যখন থলেটা অর্ধেক ভরা থাকে। সেদিন তেমনই অবস্থা।
সাইকেল চালাতে চালাতে আমরা গল্প করছি, মুরগি ডাকছে—হালকা দুলছে, আর ফর্কে ধাক্কা খাচ্ছে। বাড়ির কাছাকাছি এসে খেয়াল করলাম, মুরগি ডাকছে না। থলে ফাঁক করে দেখি, মুরগির চোখ ঢুলুঢুলু। ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে মুরগি বার করলাম—চোখ বন্ধ!
সঙ্গে সঙ্গে সবাই বকাঝকা শুরু করলো—“মরা মুরগি এনেছিস!” যতই বলি কিছুক্ষণ আগেও বেঁচে ছিল, কেউ বিশ্বাস করলো না।
শেষমেশ বাবা সবাইকে থামিয়ে বললেন, “চলো, দোকানে ফেরত নিয়ে যাই, দেখি কী বলে।”
বাবা, আমি আর বকুল আবার গেলাম সেই দোকানে। দোকানদারকে বাবা বললেন—“দাদা, কী মুরগি দিলেন! রাস্তায় আসতে আসতেই মরে গেল।” (এখানে “মরে গেল” কথাটা একটু আস্তে বলা হয়েছিল, যেমন ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজো’।)
দোকানদার হেসে বলল—“ও তাই?” তারপর মুহূর্তে মুরগির গলা কেটে দিল। আমরা তো হাঁ! ওমা! কী হলো এটা!
তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কত কেজি বলেছিলেন?” আমরা ওজন বলতেই, একই ওজনের আরেকটা মুরগি দিয়ে দিল—হাসতে হাসতে।
এদিকে আগের মরা মুরগি তখন কেটে কুটে এক বিশাল রক্তাক্ত থালায় জায়গা নিচ্ছে।

প্রায় ১০–১২ বছর পর, হঠাৎ ভাগাড় কাণ্ডে আবার মনে পড়ে গেল ঘটনাটা। বকুল মাঝে মাঝে বলতো, “সঞ্জয়, মনে আছে সেই মরা মুরগির কথা?”
অনেক ভেবে, আমি একটা অনুমান করেছিলাম—সেদিন থলে ছিল ৫০% খালি, আর হাওয়ায় দুলছিল। দুলতে দুলতে মুরগির মাথা সাইকেলের ফর্কে বারবার ধাক্কা খাচ্ছিল। পোলট্রি মুরগি তো—সহ্য করতে পারেনি। নিঃশব্দে প্রাণটা হারিয়ে ফেলেছিল।
সঞ্জয় হুমানিয়া
১৮ মে, ২০১৮, ব্যাঙ্গালোর