আজ প্রজাতন্ত্র দিবসে কিছু লিখতে ইচ্ছে হলো। ল্যাপটপে বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে ঘুড়ির কথা মনে পড়ল। এর আগেও আমি ঘুড়ি নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। আজ না হয় আর একটি লিখি, আশা করি ভালো লাগবে।
আমার নাম ঘুড়ি। হ্যাঁ, ঠিক শুনেছ। আমি এক টুকরো রঙিন কাগজ, কয়েকটা বাঁশের চিকন কাঠি আর আঠার জাদু দিয়ে তৈরি। তবে এই সামান্য উপকরণ দিয়েই আমি নীল আকাশের বুকে জায়গা করে নিই। আমার গল্পের শুরুটা খুব সাধারণ, কিন্তু একদিন আমি আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম।
আমার জন্ম এক কারিগরের হাতে। তিনি খুব যত্ন করে আমাকে তৈরি করেছিলেন। রঙিন কাগজে এমন নকশা কাটলেন, যেন দেখলেই কারও মন জুড়িয়ে যায়। কাঠি জুড়ে আমার শরীরে শক্তি দিলেন, যেন আমি হাওয়ার দাপটে ভেঙে না পড়ি। তৈরি হওয়ার পর আমি ঝুলে ছিলাম এক দোকানের জানালায়। সেখানেই প্রথমবারের মতো সূর্যের আলো আর মানুষের উচ্ছ্বাস দেখলাম।
একদিন একটি ছোট্ট ছেলে আমাকে কিনে নিল। তার চোখে যে স্বপ্ন, তা আমার চেয়েও বড়। আকাশের বুকে আমাকে উড়িয়ে দিতে সে মরিয়া। লাটাই, মাঞ্জা দেওয়া সুতো আর তার অদম্য ইচ্ছার কাছে আমি সেদিন নিজেকে ভাগ্যবান মনে করলাম।
সে দিনটি ছিল বসন্তকাল। হাওয়া ছিল দারুণ। ছেলেটি সুতোর টান ধরে আমাকে আকাশে তুলল। প্রথমে একটু লড়াই করতে হলো। হাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে একটু সময় লাগল, কিন্তু তারপরে যখন উড়তে শুরু করলাম, মনে হলো আমি মুক্ত। নিচের সবকিছু ছোট হয়ে আসছিল। বাড়ি, গাছ, মানুষ—সবই যেন খেলনা। শুধু আমি আর আকাশ।
কিন্তু, জানো, যত ওপরে উঠতে লাগলাম, ততই মনে হলো এই সুতো যেন আমাকে আটকে রেখেছে। কেন আমাকে এমন টেনে ধরে রাখা হয়েছে? কেন আমাকে আরও উপরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না? আমার মনে হচ্ছিল, যদি এই সুতো না থাকত, তবে আমি আকাশের একেবারে চূড়ায় পৌঁছে যেতাম।
আমি সুতোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলাম। বারবার হাওয়ার ঝাপটায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। সুতো আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, “আমি তোমার বন্ধু। আমি না থাকলে তুমি আকাশে উড়তে পারবে না। আমি তোমাকে সঠিক পথে রাখি।” কিন্তু আমি তা শুনলাম না।
একদিন সুতো ক্লান্ত হয়ে গেল। সে বলল, “যাও, তোমার স্বাধীনতা উপভোগ করো।” সে আমাকে ছেড়ে দিল। প্রথম কয়েক মুহূর্ত আমি উচ্ছ্বসিত। সত্যিই আমি মুক্ত! আমার আর কোনো সীমা নেই।
কিন্তু একটু পরেই হাওয়া থেমে গেল। আমি টের পেলাম, আমি নিচের দিকে পড়ছি। আমার কোনো দিশা নেই। আমি উড়ছি না, পড়ছি। শেষমেশ আমি পড়ে গেলাম একটা গাছের মগডালে। সেখানে আটকে রইলাম, একা।
তখনই বুঝলাম, সুতোর টান আমার জন্য বাধা ছিল না। সেটিই ছিল আমার শক্তি, আমার পথপ্রদর্শক। স্বাধীনতা মানে তো সীমাহীন মুক্তি নয়। স্বাধীনতা মানে সঠিক নিয়মে থেকে নিজের স্বপ্ন পূরণ করা।
আজ আমি এখানে ঝুলে আছি, কারও নজরেও পড়ি না। কিন্তু সেই ছোট্ট ছেলেটির উচ্ছ্বাস, সুতোর বন্ধুত্ব আর আকাশে উড়ার মুহূর্তগুলো আমার মনে গেঁথে আছে। সেগুলোই আমার জীবনের সেরা দিন।
শেষ কথা
আমার জীবন থেকে তোমরা একটা জিনিস শিখতে পারো—জীবনে সঠিক বন্ধনগুলোকে সম্মান করতে শেখো। কখনো কখনো যেটা বাধা বলে মনে হয়, সেটাই আসলে তোমার উড়ানের মেরুদণ্ড
–
হিউম্যানিয়া সঞ্জয়
বারাসাত – ২৬ জানুয়ারী ২০২৫