ঈদ-উল-ফিতার অর্থাৎ রোজার ঈদ। এক মাস রোজা রাখার পরে যে ঈদ পালন করা হয়, সেটাকেই চলতি ভাষায় রোজার ঈদ বলা হয়। ছোটবেলা থেকেই জানতাম যে রোজার ঈদে নতুন জামাকাপড় কিনে পরতে হয় আর কুরবানীর ঈদে নতুন জামাকাপড় পরতে হয় তবে, সেগুলো সেই আগের রোজার ঈদে যা কেনা হতো তাই।
শুধু মা কে দেখতাম রোজা করতে, আর কেউ করতো না। সন্ধ্যার ইফতারের জন্য মা চাল ভিজিয়ে রাখতো, মিছরি ভিজিয়ে রাখতো আর মাঝে মাঝে দুধ চিনি তে লেড়ো(খাস্তা বিস্কুট বিশেষ) ভিজিয়ে রাখতো। ইফতারে যে ফল, ছোলা সেদ্ধ, ছোলা ভাজা, চপ তেলে ভাজা বা বিভিন্ন মুখরোচক খাবার খায় লোকে, তা আমার জানা ছিল না সেই সময়। মা কে যা খেতে দেখতাম ভেবেছিলাম এই সবই হয়তো খেতে হয়। পরে যখন শহরে [ বারাসাতে ] এলাম তখন দেখলাম ইফতারের বাহার কত কি হতে পারে। তবে মা এখনো সেই একই রকম, ইফতারের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
ঈদের দিন সকালে উঠে দেখবো, মা রান্নাঘরে ক্ষীর রান্না করছে। এখানে আপনার যে ক্ষীরের কথা ভাবছেন, আর এই ক্ষীর এক নয়। এখন আমাদের গ্রামের অনেক উন্নতি হয়েছে, মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি ঘটেছে। আমি যে স্মৃতির কথা আজ বলবো, সেটি ১৯৯২ এর আগের কথা। তখন গ্রামে ঢেকি, ওখড়া মালা, বাঁশের খুন্তি, বেতের ধামা, চেঙ্গারি, পিতলের জলের জগ ও নানা জিনিস ব্যবহার হতো।
ধান সিদ্ধ না করে ধানকল থেকে আলো-চাল ভেনে আনা হতো। এই চাল দেখতে একটু সাদা রঙের হয়। এই চাল ঢেঁকিতে গুঁড়ো করে চালের আটা করা হয়। এই আটা দিয়ে সাধারণত পিঠে পুলি বা রুটি করা হয়। আলো চাল, নারকোল কোরা, অল্প দুধ আর গুড় দিয়ে যে পায়েস রান্না হয়, সেটাই ক্ষীর। এই ক্ষীর দুই প্রকারের হয়। গুড় দেওয়ার আগে একটু তুলে রাখা হয়, এটি মিষ্টি ছাড়া আলো ক্ষীর আর গুড় দেয়ার পর ওটা মিষ্টি ক্ষীর।
নতুন সাবান মেখে স্নান করে উঠে সাদা রঙের পাঞ্জাবী পায়জামা পরে আমি তৈরি। মাথায় হালকা নীল রঙের লম্বা টুপি, টুপির উপরে সোনালী সুতোর নকশা করা। ছোট্ট কাঁচের শিশির থেকে আতর একটি ছোট্ট তুলোয় মাখিয়ে পাঞ্জানীর কলারে মাখিয়ে নিতাম। আব্বার(বাবার) আর কাকার পরনে সাদা পাঞ্জাবী আর নতুন লুঙ্গি, মাথায় সাদা গোল টুপি। আমরা তিনজনই নামাজ পড়তে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। সঙ্গে নিতে হবে একটা মাদুর আর বড় এক বাটি ক্ষীর।
আমাদের গ্রাম চড়ুইগাছি তে কোনো ঈদগা ছিল না। একটাই মসজিদ, ঠিক গ্রামের মাখখানে। আমরা দক্ষিণ পাড়ার মানুষ। মসজিদ কে মাঝখানে রেখেই গ্রাম কে ভাগ করা হয়ে ছিল। পিঁপড়ের মতো মানুষ পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে এই মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে আসে। আমরা হেটেই যেতাম, সময় লাগতো ১৫ থেকে ২০ মিনিট। মসজিদে পৌঁছেই ক্ষীরের পাত্র জমা দিয়ে নামাজ শুরু হতো। নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে একে অপরের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হওয়া। তারপরে শুরু হতো ক্ষীর খাওয়ার পালা। বাড়িতে তৈরি করা সিমুই বা সিমাই, পায়েস, ক্ষীর আরও কত কি, যা সবাই নিজনিজ বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল, তা এবার সবাই মিলে খাওয়ার সময়।
মসজিদের সামনে খোলা ঘাসের উপর লম্বা করে সারিসারি সবাই বসবে নিজের নিজের মাদুর ভাঁজ করে, আর সামনে থাকবে কলাপাতা। এক একটা ক্ষীরের পাত্র নিয়ে সবাইকে এক হাতা করে ক্ষীর দিয়ে শুরু। সেই পাত্রের ক্ষীর ফুরিয়ে গেলে আবার নতুন পাত্র তুলে নিতো পরিবেশক। কয়েকজন মাত্র পরিবেশন করবে আর সারা গ্রামের মানুষ এই একটা দিন একে অপরের বাড়ির ক্ষীর একসঙ্গে বসে খাওয়া হতো। কোনো বার দুই হাতা বা তিন হাতা আলাদা বাড়িতে ক্ষীর পাতে পড়তো। এখন ভেবে অবাক হয়ে যাই, কি সুন্দর একটা ব্যবস্তা বা নিয়ম ছিল সেই সময়। ধরুন আপনি ক্ষীর নিয়ে যাননি বাড়ি থেকে, তাতে কি হয়েছে? আপনিও বসে খেতে পারেন সকলের সাথে।
আমার যতদূর মনে পড়ে, এই ঈদের নামাজ এর পরে বসে ক্ষীর খাওয়ার সময় আমি আমাদের বাড়ির ক্ষীর কোনদিন খাইনি, খেয়েছি বিভিন্ন বাড়ির বিভিন্ন স্বাদের ক্ষীর আর সিমুই বা সিমাই। এখন আর সেই নিয়ম আছে কি না জানি না। বহু বছর আমি এই গ্রামের মসজিদে ঈদের নামাজ পড়িনি। অনেক জায়গায় ঈদের নামাজ পড়েছি, অন্যান্য রাজ্যেও ঈদের নামজ পড়েছি, কিন্তু আমাদের গ্রামের সেই নিয়ম কোথায় দেখিনি। ছোটবেলায় ভাবতাম, এটাই হয়তো ঈদের নিয়ম, সব জায়গায় এমনই হয়তো হয়। এখন বুঝতে পারি, শৈশবের এই অভিজ্ঞতা এক অমূল্য স্মৃতি ।
সঞ্জয় হুমানিয়া
১২ই মে ২০১১, বারাসাত, পশ্চিমবঙ্গ, ইন্ডিয়া
★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★