[mks_dropcap style=”letter” size=”52″ bg_color=”#ffffff” txt_color=”#000000″]আমি[/mks_dropcap] গল্প বা উপন্যাস লিখতে পারি না। যেটুকু লিখি সবটুকুই স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা। দৈনন্দিন জীবনের সাদামাটা টুকরো টুকরো সব ঘটনা। তবে সব ঘটনা লিখে রাখি না, শুধুমাত্র অতীতের কোন ঘটনা যা আমার মনে দাগ কেটেছিল বা বর্তমানে ঘটে যাওয়া কিছু মুহূর্ত চেষ্টা করি লিখে রাখতে।
গতকাল ১লা মে, শ্রমিক দিবসে আপিসে মানসিক শ্রম করে ঘরে ফিরেছিলাম বিকাল সাড়ে চারটে বা পাঁচটা। তারপর স্নান সেরে টানা সন্ধ্যা পর্যন্ত অসুস্থ মুরগীর মত ঝিমিয়েছিলাম। ঝেমাতে আমার ভালো লাগে, অনেক বাঙালি এই ‘ঝেমানো’ কে সভ্য আধুনিক ভাষায় ‘ল্যাদ’ বলে। তবে আমার এই ‘ল্যাদ‘ শব্দটি পছন্দ হয় না, কেমন যেন অতি নিম্নমানের শব্দ বলে মনে হয়।
কিছুদিন থেকে সন্ধ্যায় আমার কেমন যেন একটি খুচরো খিদে পাচ্ছিলো, গতকাল ও পেয়েছিল। আমি ভোজন রসিক মানুষ, পাছে এই খুচরো খিদে না পালিয়ে যায় তাই আমি তাড়াতাড়ি একটি গেঞ্জি গলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম উদরের জ্বালা মেটাতে। প্রথমে দশ টাকার চারটে মেদু বড়া দুবার খেলাম, অর্থাৎ মোট আটটা। তারপর একটি মুচমুচে সিঙ্গারা।
ঘটনার শুরু এই তেলেভাজার দোকান থেকে। সরকার বাহাদুরের দয়ায় আমাদের দেশ এখন ক্যাশ লেস ইন্ডিয়া হওয়ার চেষ্টা করছে। হোঁচট খাচ্ছে পড়ছে আবার উঠে দাঁড়িয়ে চলছে এই প্রকল্প। কিছু রাজ্যে ক্যাশ লেস প্রকল্প সুন্দর ভাবে চলছে, ব্যাঙ্গালোরেও মোটামুটি চলছে। আমি যতটা সম্ভব ক্যাশ লেস ভাবে লেনদেন করার চেষ্টা করি, সেটা ১০ টাকা হোক বা ১০০০ টাকা হোক।
আমি মগ্ন হয়ে সিঙ্গারা খাচ্ছি, আমার পাশে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটি নিজের খাওয়া শেষ করে পকেটের ভিতরের কাপড়ে হাত মুছে পিছনের পকেট থেকে জরাজীর্ণ টাকা রাখার ব্যাগ বার করে দোকানদার কে দাম মেটাচ্ছিলো। ছেলেটি দুটি ১০ টাকার কয়েন দিয়েছিল সিঙ্গারারা দাম হিসাবে। কিন্ত সমস্যা হলো ব্যাঙ্গালোরে কেউ ১০ টাকার কয়েন নিতে চায় না বহুদিন থেকে। রাস্তাঘাতে বহুদিন কাউকে ১০ টাকার কয়েন ব্যাবহার করতেও দেখিনি। কি একটা গুজব উঠেছিলো যে কিছু ১০ টাকার কয়েন নাকি নকল। কিন্তু পরে আবার সরকার বাহাদুর বিজ্ঞপ্তি জানিয়েছিল যে সব ১০ টাকার কয়েন বৈধ। সাধারণ মানুষের মনে এখন অনেক প্রশ্ন, সংবাদ পত্র ও টিভিতে যে সব নকল ১০ টাকা তৈরির ছবি ও ভিডিও দেখিয়েছিল সেগুলো তাহলে কি?
যাইহোক, এদিকে দোকানদার তো কিছুতেই ১০ টাকার কয়েন নিলো না বেশ কিছুক্ষণ তর্কাতর্কি করে। বাধ্য হয়ে ছেলেটি অন্য নোট দিয়ে দাম মেটালো। এই ঘটনার দাগ আমার মনে মিটতে না মিটতে আমার সঙ্গেই ঘটে গেল সেই একই ঘটনা। পরের দিন সকালে আপিস যাবো বলে বাসে উঠে বসেছি, বাস তখনো ছাড়েনি। কন্ডাকটর প্রতিদিনের মত ভাড়া চাইলো, আমি একটা ১০০ টাকার নোট দিলাম ভাঙানি টাকা নেই তাই। আপিস যাওয়ার আমার বাস ভাড়া মাত্র ২৫ টাকা। আজ পর্যন্ত এমন কোনদিন হয়নি যে আপিস যাওয়ার পথে ১০০ বা ৫০০ এই ২৫ টাকা ভাড়ার জন্য খুচরো হয়নি। কিন্তু আজ সে ঝামেলা হলো।
বাস কন্ডাক্টর আমাকে ফেরৎ হিসাবে একটি ৫০ টাকার নোট, দুটি ১০ টাকার কয়েন এবং একটি ৫ টাকার কয়েন দিলো। আমার তো বুকটা ধড়াস করে উঠলো। এবার আমি এই ১০ টাকার কয়েন কাকে দেবো? গত কালকেই চোখের সামনে দেখলাম ১০ টাকার কয়েন অচল এই শহরে। আমার ঘরেও আগে থেকে কয়েকটা ১০ টাকার কয়েন পড়ে আছে, কেউ নিতে চায় না, আবার এই দুটো কয়েন এলো সংগ্রহে।
এই সব ভাবতে ভাবতে কন্ডাকটর কে ডেকে বললাম – “আন্না, এই ১০ টাকার কয়েন কেউ নিতে চায় না, পাল্টে দাও”। আন্না তো এদিকে আমাকে লম্বা চওড়া লেকচার দিতে শুরু করলো ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে। সরকারি বিজ্ঞপ্তির কথাও বলল, সঙ্গে অনেক ফিরিস্তি। আমি শেষমেশ বললাম – “সবই তো বুঝলাম, আমার নিতে কোন বাধা নেই তবে অন্য কেউ নিতে চায় না, গতকালই আমার সামনে এক দোকানদার নিলো না”। এই বলাতে কন্ডাকটর স্বাভাবিক ভাবে আমাকে বলল, হয় খুচরো দিতে হবে, না হয় সরকারি বাস থেকে নেমে যেতে। আন্না নিজের ব্যাগ থেকে একটা ১০০ টাকার নোট বার করে আমার উদ্দেশ্যে তুলে ধরলো।
এমন পরিস্থিতিতে আমার আর কিছু করার নেই। টিকিট ফেরৎ দিয়ে টাকা ফেরৎ নিয়ে সরকারি বাস থেকে নেমে এলাম। সকারের টাকা, সরকারের বাস, আমি সামান্য ছাপোষা মানুষ। মনে অপমান, রাগ আর ঘৃণা নিয়ে কিছুখন বাস স্ট্যান্ডে দাড়িয়ে রইলাম। আপিস যাওয়া আজ একটু দেরি হয়ে গেলো। একটু পরে অন্য সরকারি বাস এলো, আমি ভয়ে ভয়ে উঠে বসলাম। ভয়ে ভয়ে আবার সেই ভাঁজকরা অতি পরিশ্রম করে উপার্জন করা ১০০ টাকার নোট দিলাম বাস কন্ডাক্টর কে। ইনি চুপচাপ ২৫ টাকার টিকিট আর সঙ্গে একটি ৫০ টাকা, একটি ২০ টাকা, একটি ৫ টাকার কয়েন ফেরৎ দিলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
সঞ্জয় হুমানিয়া – বেঙ্গালুরু
০২ মে ২০১৯
★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★