আমি গল্প বা উপন্যাস লিখতে পারি না। যেটুকু লিখি, সবটুকুই স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা। দৈনন্দিন জীবনের সাদামাটা টুকরো টুকরো কিছু ঘটনা। তবে সব ঘটনা লিখে রাখি না—শুধুমাত্র অতীতের কোনো ঘটনা, যা আমার মনে দাগ কেটেছিল বা বর্তমানে ঘটে যাওয়া কিছু মুহূর্ত, চেষ্টা করি লিখে রাখতে।
গতকাল ১লা মে, শ্রমিক দিবসে অফিসে মানসিক শ্রম করে ঘরে ফিরেছিলাম বিকেল সাড়ে চারটা বা পাঁচটার দিকে। তারপর স্নান সেরে টানা সন্ধ্যা পর্যন্ত অসুস্থ মুরগির মতো ঝিমিয়েছিলাম। ঝিমোতে আমার ভালো লাগে, যদিও অনেক বাঙালি এই ‘ঝিমানো’-কে সভ্য আধুনিক ভাষায় ‘ল্যাদ’ বলে। তবে আমার ‘ল্যাদ’ শব্দটি পছন্দ নয়—কেমন যেন অতি নিম্নমানের শব্দ মনে হয়।
কিছুদিন ধরে সন্ধ্যায় কেমন একটা খুচরো খিদে পাচ্ছিলাম, গতকালও পেয়েছিলাম। আমি ভোজনরসিক মানুষ—পাছে এই খিদে না পালিয়ে যায়, তাই তাড়াতাড়ি একটি গেঞ্জি গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম উদরের জ্বালা মেটাতে। প্রথমে দশ টাকায় চারটি মেদু বড়া খেলাম—দুইবার, অর্থাৎ মোট আটটা। তারপর খেলাম একটি মুচমুচে সিঙ্গারা।
ঘটনার শুরু এই তেলেভাজার দোকান থেকেই। সরকার বাহাদুরের দয়ায় আমাদের দেশ এখন ক্যাশলেস ইন্ডিয়া হওয়ার চেষ্টা করছে। হোঁচট খাচ্ছে, পড়ছে, আবার উঠে দাঁড়িয়ে চলছে এই প্রকল্প। কিছু রাজ্যে এই ক্যাশলেস ব্যবস্থা ভালোই চলছে, ব্যাঙ্গালোরেও মোটামুটি চলছে। আমি যতটা সম্ভব ক্যাশলেস লেনদেনের চেষ্টা করি—সে ১০ টাকা হোক বা ১০০০ টাকা।
আমি তখন মগ্ন হয়ে সিঙ্গারা খাচ্ছি। আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি নিজের খাওয়া শেষ করে পকেটের ভেতরের কাপড়ে হাত মুছে, পিছনের পকেট থেকে জরাজীর্ণ টাকা রাখার ব্যাগ বার করে দোকানদারকে দাম মেটাচ্ছিল। ছেলেটি দুটি ১০ টাকার কয়েন দিয়েছিল সিঙ্গারার দাম হিসাবে। কিন্তু সমস্যা হলো, ব্যাঙ্গালোরে বহুদিন ধরেই কেউ ১০ টাকার কয়েন নিতে চায় না। রাস্তাঘাটে বহুদিন কাউকে ১০ টাকার কয়েন ব্যবহার করতেও দেখিনি। একটা গুজব ছড়িয়েছিল যে কিছু ১০ টাকার কয়েন নকল। পরে সরকার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল যে সব কয়েনই বৈধ। তবু সাধারণ মানুষের মনে এখনও সন্দেহ। সংবাদপত্র আর টিভিতে যে সব নকল ১০ টাকার ছবির ভিডিও দেখিয়েছিল, সেগুলো তাহলে কী?
যাই হোক, দোকানদার কিছুতেই ১০ টাকার কয়েন নিল না। বেশ কিছুক্ষণ তর্কাতর্কির পর ছেলেটি বাধ্য হয়ে অন্য নোট দিয়ে দাম মেটালো। এই ঘটনার রেশ আমার মনে মিটে যাওয়ার আগেই, পরদিন আমার সঙ্গেই ঘটলো একইরকম ঘটনা।
পরদিন সকালে অফিস যাব বলে বাসে উঠে বসেছি। বাস তখনও ছাড়েনি। কন্ডাক্টর প্রতিদিনের মতো ভাড়া চাইলো। আমি একটা ১০০ টাকার নোট দিলাম, কারণ খুচরো ছিল না। অফিস যাওয়ার বাসভাড়া মাত্র ২৫ টাকা। আজ পর্যন্ত এমন হয়নি যে ১০০ বা ৫০০ টাকার নোট দিলে খুচরো মেলেনি। কিন্তু আজ ঝামেলা হলো।
কন্ডাক্টর আমাকে ফেরত দিলো একটি ৫০ টাকার নোট, দুটি ১০ টাকার কয়েন, আর একটি ৫ টাকার কয়েন। বুকটা যেন ধড়াস করে উঠলো। এই ১০ টাকার কয়েন এখন আমি কাকে দেবো? গতকালই তো দেখলাম কেউ নিচ্ছে না। বাড়িতেও আগে থেকে কিছু ১০ টাকার কয়েন পড়ে আছে—কেউ নিতে চায় না, আর আজ আবার দুটো এলো!
সব ভাবতে ভাবতে কন্ডাক্টরকে বললাম, “আন্না, এই ১০ টাকার কয়েন কেউ নিতে চায় না, পাল্টে দাও।”
আন্না শুরু করলো ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে লম্বা একটা লেকচার। সরকারি বিজ্ঞপ্তির কথাও বললো, সঙ্গে অনেক যুক্তি।
আমি শেষে বললাম, “সবই তো বুঝলাম। আমার নিতে কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু কেউ নিতে চায় না। গতকালই আমার সামনে এক দোকানদার নেয়নি।”
এই কথায় কন্ডাক্টর স্বাভাবিক ভাবেই বললো, হয় খুচরো দিতে হবে, না হলে সরকারি বাস থেকে নেমে যেতে হবে।
আন্না নিজের ব্যাগ থেকে একটা ১০০ টাকার নোট বার করে আমার দিকে তুলে ধরলো।
এমন পরিস্থিতিতে আমার আর কিছু করার ছিল না। টিকিট ফেরত দিয়ে টাকা ফেরত নিয়ে সরকারি বাস থেকে নেমে এলাম। সরকারের টাকা, সরকারের বাস, আমি সামান্য ছাপোষা মানুষ। মনে অপমান, রাগ আর বিরক্তি নিয়ে কিছুক্ষণ বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে রইলাম। অফিস যেতে একটু দেরি হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পরে আরেকটা সরকারি বাস এলো। আমি ভয়ে ভয়ে উঠলাম। আবার সেই ভাঁজকরা পরিশ্রমের ১০০ টাকার নোট দিলাম কন্ডাক্টরকে।
এবার উনি চুপচাপ ২৫ টাকার টিকিট আর ফেরত দিলেন ৫০ টাকা, ২০ টাকা, আর ৫ টাকার কয়েন।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
সঞ্জয় হুমানিয়া – বেঙ্গালুরু
০২ মে ২০১৮
★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★