৯০ এর দশকের স্মৃতি আমার। প্রায় বিকেলে মাকে দেখতাম হ্যারিকেনের কাঁচ মুছতে। গত রাতের কালী পড়া কালো কুচকুচে কাঁচ। প্রথমে এক ফালি ছেঁড়া কাপড় দিয়ে মুছে নিতো, তার পর ওই কাপড়ের অন্য পরিস্কার দিক দিয়ে final touch দিতো, আর সব শেষে বিশেষ সাবধানতায় হ্যারিকেনের কাচ, মুখের ভাপ দিয়ে ঝকঝকে পরিস্কার করে তুলতো। আমার ভূমিকা ছিল দর্শকের বা দার্শনিকের। আমাদের গ্রামের বাড়ির পশ্চিম দিকে রান্না ঘর, মাটির মেঝে, ইটের দেওয়াল আর সেই দেওয়ালের উপরে পরিপাটি করে মাটির প্রলেপ দেওয়া। দরোজা ও জানাল বাঁশের বেড়া দিয়ে বানানো আর উপরে টালির ছাউনি।

পাশাপাশি দুটি শোয়ার ঘর, সেকালের ইটের পাকা বাড়ি, লাল রঙের মেঝে, সাদা চুনকাম করা দেওয়াল, মোটামোটা কালো রঙের কাঠের দরজা জানলা, উঁচু ছাদ, উঁচু বারান্দা। সামনে খোলা উঠোন, উঠোন থকে বারান্দায় উঠতে উঁচু উঁচু চারটে ধাপের সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রথমে বারান্দা, তারপর শোয়ার ঘর দুটি পাশাপাশি। দুটি ঘরের দরজার মাঝখানে যে দেওয়াল, সেখানে একটা বড় খুপরি, নাম পানের সাজির জানলা। বারান্দার পশ্চিম দিকে একটি চার ধাপের সিঁড়ি, যেটা দিয়ে রান্না ঘরে যাওয়া যায়। আমার বসার যায়গা এই পশ্চিম দিকের সিঁড়িতে, পা ঝুলিয়ে মা কে হ্যারিকেনের কাঁচ মুছতে দেখা।

হাত বাঁচিয়ে কীভাবে হ্যারিকেনের কাচ পরিস্কার করতে হয়, তা রপ্ত হতে সময় লেগেছিল আমার প্রচুর। হ্যারিকেনের কাচ পরিস্কার শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঝুপ করে সন্ধ্যা আর সন্ধ্যাবেলায় হ্যারিকেনের আলোয় বই খুলে বসলেই আমার দারুন ঘুম পাওয়া শুরু, অথচ মা জননী নাছোড় বান্দা, রান্না ঘর থেকে চিল্লিয়ে ডাকতেন, “কী রে পড়া বন্ধ কেন?”, ব্যাস, আবার উচ্চস্বরে মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়া শুরু। আহা, সেই সব দিনগুলো। রাত গাঢ় হয়ে আসার সাথে সাথেই রান্না ঘর থেকে রান্নার সুগন্ধ, ঘুম আর খিদে দুজনে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলতো আমার পড়ায় বিঘ্ন ঘটাবার।

Image courtesy: Ayan Mazumder

আমাদের কয়টি আলাদা আলাদা ধরনের হ্যারিকেন ছিল, প্রথমত তারা বিভিন্ন রঙের, সবুজ, নীল, লাল, হলুদ ইত্যাদি। দ্বিতীয় হ্যারিকেনের কাঁচে অনুযায়ী দুই ধরনের। বড় কাঁচ আর ছোট কাঁচ। বড় কাঁচের হ্যারিকেন সকলের বাড়িতেই দেখেছিলাম সেই সময়, কিন্তু এই ছোট কাঁচের হ্যারিকেন সারা গ্রামে ওই এইটাই ছিল আমাদের বাড়ি। ধরমপুর (ধর্মপুর) বাজারে এই ছোট হ্যারিকেনের কাঁচ কিনতে পাওয়া যেত না, গণ্ডার মার্কা ছোট কাঁচ পাওয়া যেত একমাত্র হাবরা বাজারের কোন এক নির্দিষ্ট দোকানে। মা চিনতো সে দোকান, আমি নিজেও গিয়েছি মায়ের সাথে সেই দোকানে, কাঁচ কিনতে। মায়ের মুখে শুনেছিলাম, গণ্ডার মার্কা কাঁচ ভালো, অন্য কোম্পানির কাঁচে ঠুক করে লাগলে ভেঙ্গে যায় কিন্তু গণ্ডার মার্কা কাঁচ সহজে ভাঙতে চায় না। যখনই এই ছোট হ্যারিকেনের কাঁচ কিনতে যাওয়া হতো, মা একসাথে দুটি কাঁচ কিনে আনতো, কারন ওটা ছিল দুষ্প্রাপ্য আমাদের কাছে।

আমি হাত এবং কাঁচ বাঁচিয়ে হ্যারিকেনের কাঁচ পরিস্কার করার চেষ্টায় কয়েকবার এই দুষ্প্রাপ্য ছোট কাঁচ ভেঙ্গেছি। এখন আর হ্যারিকেন ব্যাবহার হয়না, কারেন্ট এসেছে অনেক দিন। কোন এক গুদাম ঘরে হয়তো ঝুলিয়ে রাখা আছে সেই বহু পরিচিত সেই দুষ্প্রাপ্য ছোট কাঁচের হ্যারিকেন। এখন মাঝে মাঝে বড্ড মন খারাপ করে সেই হ্যারিকেনটির জন্য।

সঞ্জয় হুমানিয়া
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ (অরঙ্গাবাদ – মহারাষ্ট্র)

★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *