গল্প বা উপন্যাস শুধু কাগজের বইয়ের পাতায় থাকে না। প্রত্যেকটি মানুষ এক একটি গল্প,  এক একটি উপন্যাসের উদাহরণ। প্রত্যেক মানুষের যেমন আঙুলের ছাপ একে অপরের থেকে আলাদা, ঠিক তেমনই প্রত্যেক মানুষ-গল্প এক একটি থেকে আলাদা। একটি গল্প অন্য একটির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও ভিন্ন স্বাদের। বাসে, ট্রামে, রাস্তা, ঘাঁটে গল্প চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। শুধু মাত্র হাত ধরে পাশে বসিয়ে সেই সব গল্প বা উপন্যাস শোনার কেউ নেই। আগ্রহী সকলেই যে যার নিজের গল্প শোনাতে। সকল মানুষই চায় তার নিজের জীবন-গল্প সবাইকে শোনাতে। কিন্তু এ বাজারে শ্রোতা পাওয়া খুবই মুশকিল। কারন সকলেই তো শুধু শোনাতে চায়, কেউ শুনতে চায় না। আজকের গল্প The story of a jalebiwala.

গল্পের সন্ধান আমার চিরকালের। রাস্তাঘাঁটে চলাফেরার সময় যদি কোন গল্প দেখি, আমি চেষ্টা করি সেই গল্পকার কে একটি শ্রোতা উপহার দিতে। শ্রোতা হিসাবে আমি ছোট থেকেই খুব ভালো। একজন গল্পকার যদি একটিও ভালো শ্রোতা পায়, সে চেষ্টা করে তার ঝুলি থেকে সব গল্প বা অভিজ্ঞতা নিংড়িয়ে শেষ ফোটা টুকু শ্রোতার কাছে তুলে ধরতে। সত্যি বলতে একমাত্র একজন মনোযোগী শ্রোতাই শুধুমাত্র পারে একজন গল্পকারের কাছ থেকে তার গল্পের সবটুকু বিস্তারিত বর্ণনার সাথে সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা প্রকাশ করাতে।

সেদিন সন্ধায় আপিস ফেরার পথে ছোট্ট একটি বাস-ঢলুনি আর তার পরে ঘরে ফিরে আধ ঘণ্টার পাওয়ার ন্যাপ। শুনেছি নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এবং টমাস আলভা এডিসন ও এমন কুড়ি মিনিট বা আধ ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতেন কাজের ফাঁকে। আমি যেদিন থেকে এই তথ্য জানতে পারি, আমিও মহাপুরুষ হওয়ার লোভ ছাড়তে পারলাম না। আমিও তাদের এই ঘুমের বাতিকটি আয়ত্ত করতে শুরু করলাম।

বিকালে একটু রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়ে প্রথমে একটু এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি শুরু করলাম। তারপর একটি ছোট্ট খিদে অনুভব করার পর থেকেই খাবারের দোকানের দিকে চোখ নাচাতে শুরু করেছিলাম। মনের ভিতরে একটি “কি খাই কি খাই” ভাব। মন বলছে, “আজ কুছ মিঠা হোযায়ে!!”। মনের সাথে তাল মিলিয়ে, ওর হ্যাঁ য়ে হ্যাঁ মিলিয়ে আমার পা দুটি আমাকে টেনে নিয়ে গেলো জিলাপির দোকানে। মুখ পরিচিত দোকান, আমি দোকানদার কে চিনি আর দোকানদার আমাকে চেনে। আমারা একে-অপরের নাম না জানা পরিচিত মানুষ।

বেঙ্গালুরুতে সন্ধ্যায় রাস্তার ধারে আপনি কয়েকটি খাবার খুব সহজেই পাবেন। নিরামিষ ও আমিষ লেতেভাজার ঠ্যালা গাড়ি, ইডলি ধোসার ঠ্যালা গাড়ি এবং জিলাপির দোকান। বেঙ্গালুরুতে মধ্যবিত্ত নেই, আমি যতদূর দেখেছি। শুধুমাত্র আমার মত নিম্নবিত্ত মানুষ যারা পায়ে হেটে খাবারের সন্ধান করে, তারাই এই সব ঠ্যালা গাড়িতে খেতে সক্ষম। এই সব ঠ্যালা গাড়ি রেস্তরার কোন car parking এর সুবিধা থাকে না। সুতরাং উচ্চবিত্তদের ইচ্ছা থাকলেও এখানে সব সময় ঠ্যালা গাড়ি রেস্তরায় খাওয়া হয়ে ওঠে না। আবার এটাও দেখেছি, অনেকেই অনেক দূরে তাদের চার চাকা যুক্ত বাহন রেখে এসে এই রেস্তরায় খায়। জানি না, এই গাড়ি দূরে রেখে এসে খাওয়ার পিছনে আসল কারন কি। হয়তো সত্যি সত্যি গাড়ি রাখার জায়গা থাকে না তাই দূরে রেখে আসে, অথবা সম্মান বাঁচাতে।

যাইহোক, জিলাপির দোকানে উপস্থিত হয়ে দেখি গরম তেলে জিলাপি ভাজা হচ্ছে। পাশে কড়াইয়ে হলুদ রঙের রস। আমাকে দেখে মিটিমিটি হেঁসে দু মিনিট দাড়াতে বলল। জিলাপি আছে, তবে সে আমাকে ঠাণ্ডা জিলাপি খাওয়াতে চায় না। অন্য গ্রাহক কে আগের ভাঁজা জিলাপি দিচ্ছে। আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে তার চমৎকার দোকানদারী দেখছি। ছেলেটি আমার সমবয়সী, রাজেস্থানের বাসিন্দা, হিন্দি বলতে পারে। হলদেটে আলোয় রস চুকচুকে জিলাপি এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। হোক না রাস্তার ঠ্যালা গাড়ি রেস্তরা, হোক না রাস্তার ধূলো, এ মায়াবী রূপী জিলাপির হাতছানি কোন ভোজনরসিক অবজ্ঞা করতে পারবে না। আমার মন বললো,

“তোল না একটা ছবি, এমন জিলাপি আর কোথায় পাবি!”

আমি পকেট থেকে মুঠোফোন বার করে প্রথম ছবি তুললাম জিলাপির, তার পর সমস্ত দোকানের। এখানেই আমাদের গল্পের শুরু! জিলাপিওয়ালা আচমকা পিছিয়ে গেলো। একদম ফ্রমের বাইরে। ছবিতে দোকানদার নেই। দোকানদারী করতে করতে হিন্দিতে বললেন তার ছবি না তুলতে। আমি কৌতূহলী হয়ে কারন জিজ্ঞাসা করলে সে হাতের কাজ শেষ করে তার চরম বাস্তব গল্পটি আমার সামনে তুলে ধরলেন। আমি তার গল্পের সংক্ষিপ্ত বাংলা বর্ণনা তুলে ধরছি।

বছর দুয়েক আগে সে রাজেস্থান থেকে কাজের সন্ধানে এই স্বপ্নের বেঙ্গালুরুতে এসেছিলেন। বেশি লেখাপড়া সে শেখেনি। অনেক কষ্ট করে এই জিলাপির দোকান দাঁড় করিয়েছে। ওর বাড়িতে বা দেশের কেউ জানে না যে সে এখানে জিলাপি বিক্রি করে। তার বাড়ির মানুষ জানে যে সে এখানে কোন এক কম্পানিতে চাকরি করে। সে চায় না যে কোন ভাবেই এই কাজের খবর তার বাড়ির মানুষের কাছে পৌছায়, তাই সে অনেক সাবধানতা অবলম্বন করে এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে।

গল্পটি শোনার পরে আর ৫জন মানুষের মতই আমিও মহাপুরুষ হয়ে জ্ঞান দিতে শুরু করলাম।

“কোন কাজই ছোট নয়। যে কোন কাজ কে বড় করে দেখার মানুষিকতা তৈরী করতে হবে আমাদের। দু-কলম শিখে নিজেকে এতটাই বড় শিক্ষিত মনে করছি আমার যে কাজ কে ছোট করে দেখতে শুরু করি। আমার ভাবতে শুরু করি এ কাজ আমার জন্য নয়। লজ্জা তাদের জন্য যারা নিজেকে শিক্ষিত দাবী করে বেকার বসে থাকে। আপনি তো জিলাপির দোকান দিয়েছেন। আমাদের শেখার আছে অনেক কিছুই আপানার থেকে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করার সময় এখনই”

লক্ষ্য করলাম আমার এই জ্ঞানের বানী চলাকালীন সে কোন রকম বাঁধা দিলো না বা উত্তর দিলো না। সে নিজের কাজ করতে করতে মিষ্টি একটা হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। আমার কথা শেষ হওয়ার পরে সে খুব সহজ ভাবে বলেছিলেন –

“স্যার, সব জানি। এই সব কথাগুলি সোশ্যাল মিডিয়াতে পড়তে খুব ভালো লাগে। পড়ার পরে আমদের পরিচিত বেকার কর্মহীন মানুষের সাথে শেয়ার করতেও ভালো লাগে। কিন্তু বাস্তবটি একটু অন্য রকম। আজ মানুষের সম্মান তার কাজ সাথে। কেউ ধরুন কোন এক বড় কম্পানিতে কেরানীগিরি করে, হয়তো তার থেকে আমি বেশি উপার্জন করি, তবুও সমাজে তার সম্মান বেশি।

KFC তে টেবিল মোছার কাজ করেও সম্মান আছে, কিন্তু জিলাপি বেচে নেই। স্যার, আপনি নিজের মন কে প্রশ্ন করে দেখুন, KFC বা অন্য এই ধরনের খাবার দোকানে গিয়ে আপনি তাদের কর্মচারীদের সাথে কত ভদ্র ভাবে ইংরাজিতে কথা বলেন, কত সম্মান আদান প্রদান করেন। কোন দিন জিলাপিওয়ালার সাথে তেমন ব্যাবহার করে দেখেছেন? বা করতে ইচ্ছা হয়?”

সঞ্জয় হুমানিয়া
৮ জানুয়ারি ২০১৯ – বেঙ্গালুরু

★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *