আমার শৈশব আর আমার ছোট বোনের শৈশবের মধ্যে অনেক পার্থক্য। আমি সেকালের শেষের ৮০র দশক আর আমার ছোটবোন একালের। আমি আর দিদি নারকেলের মালা আর ধুলো নিয়ে রান্নাবাটি খেলতাম, ছোট বোন স্মার্ট ফোন নিয়ে খেলে। সেকালে একটা ভর ভরন্ত সংসার, সংসারে অভাব বলে কিছু ছিল না। দিদি বড়, তার পর আমি, তার অনেক পরে আমার ছোট বোন। ছোট বোন এখন মটেই ছোট নেই, এবছর ২০১৮ তে বাংলায় এম.এ শেষ করে বি.এড করছে।
১৯৯০-৯১ এর স্মৃতি আমার, গ্রামের বাড়ির সাথে মস্ত বড় ভাগের পুকুর, ভাগের আম বাগান, বাস বাগান, বড় উঠোন। বড় উঠনের এক কোনে ছোট কিন্তু বয়স্ক লিচু গাছ, ঠিক তার পাশে দুটি নারকেল গাছের মাঝখানে বিচুলির গাদা। পুকুর পাড়ে একটি নারকেল গাছ, এ নারকেল গাছটি একটু অন্য রাকম, হলুদ রঙের ডাব হয়। আরও কয়েকটি নারকেল গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভিটেবাড়ির এদিক ওদিক। মাঝে মধ্যে গাছ থেকে ডাব, নারকেল পাড়ানো হতো, গ্রামের এক ডাব বিক্রেতার সাহায্যে। ডাব-ওয়ালা সাইকেল চড়ে আসতেন, সে এক বিশেষ ধরনের সাইকেল। সাইকেলের পিছনের চাকার দুই পাশেই লাগানো থাকতো বাঁশের বেড়ার মত ছোট ছোট গার্ড, ঠিক যেমন মোটর সাইকেল পিছনের চাকার দুই পাশে থাকে, স্টিলের শাড়ী গার্ড। পিছনে একটা মস্ত বড় ক্যারিয়ার, সাইকেল কে দাঁড় করানোর স্ট্যান্ড নেই, আছে একটা বাঁশের মোটা লাঠি। লাঠির এক মাথা মাটিতে আর অন্য মাথা সিটের নিচে থাকা রডে ঠেকিয়ে সুন্দর ভাবে দাঁড় করিয়ে রাখতো সাইকেল। চকচকে একটি ধারালো দা ঝোলানো থাকতো সাইকেলের হ্যান্ডেলে।
পায়ে একটি ছোট গোল দড়ির সাহায্যে সাইসাই করে উঠে পরতেন গাছে, কোমরে গামছা আর লম্বা দড়ি বাধা, দা গোজা আছে কোমরের গামছায়। প্রথমের ডাবের কাধি কেটে, দড়ির সাহায্যে নিচে নামিয়ে দিতেন, তার পর দুমালা নারকেলের কাধি, আর সব শেষে ঝুনো নারকেন। বেশি অংশের ডাব ওনাকেই বিক্রি করে দিতে হতো, বাড়িতে রাখা হতো নিজেদের খাওয়ার জন্য কিছু।
[foogallery id=”11398″]
বাড়িতে তখন ডাব খাওয়ার ধুম, নিয়ম করে দিনে ২টি বা কেউ কেউ ৩টি করে ডাব খাওয়া চলতে থাকতো বেশ কিছু দিন। দুমালা নারকেল খাওয়া হতো মুড়ির সঙ্গে অথবা বাড়ির খেজুরের ঝোলা গুড়ের সাথে। ঝুনো নারকেল রাখা হতো শোয়ার ঘরের খাটের নিচে। ঝুনো নারকেলের অনেক ব্যাবহার। ঠাকুমা, মা আর কাকিমার খেয়ালের উপরে নির্ভর করে এই ঝুনো নারকেল কোন কাজে ব্যাবহার করা হবে। সব থেকে বেশি ব্যাবহার হতো বাড়িতে পোলাও রান্না করার জন্য, দ্বিতীয় পিঠে পুলি আর তৃতীয় নারকেল তেল বানাতে জন্য।
পোলাও রান্না করতে প্রথমে নারিকেলের খোসা ছাড়িয়ে শক্ত আবরণ দুই ভাগে বিভক্ত করে কুর্নির সাহায্যে নারকেল কুরে নেওয়া হতো। এই কোরানো নারকেলের সাথে সামান্য জল মিশিয়ে ভালো করে হাত দিয়ে ডলে চটকানো হয়। ফলে নারকেলের তেল বা চর্বি পানির সংগে মিশে দুধের আকার ধারণ করে। নারকেলের দুধ দিয়ে পোলাও, ডিমের কোর্মা, পিঠা, ইলিশ মাছ, মাংস রান্নার প্রচলন বহু পুরোনো। রূপচর্চার জন্য নারকেলের দুধ ব্যবহার করা হয়।
ঘরের যেকোনো চালেই পোলাও হতো আমাদের বাড়িতে। পোলাওয়ের চাল ভিজিয়ে ছেঁকে রাখা হতো। হাঁড়িতে নারকেলের দুধ, গরম মসলা, তেজপাতা, চিনি ও লবণ দিয়ে ফুটিয়ে চালগুলো ঢেলে নেড়েচেড়ে ঢেকে দেওয়া হতো। চাল ফুটে উঠলে এবং জল শুকিয়ে আসার পর জাফরানি রঙ মেশানো হতো। রঙ এমন ভাবে মেশানো হতো যাতে অর্ধেক পোলাও সাদা আর অর্ধেক জাফরানি। সাপ্তাহিক বাজার করার সময় এই রঙ কেনা নিয়ে মা বার বার সতর্ক করে দিতো। গাই এর ছবিওয়ালা জাফরানি রঙই কিনে আনতে হবে। পোলাওয়ের সাথে থাকতো মিহি আলু ভাজা, ছোট মাছ ভাজা, নারকেলের দুধ দিয়ে বানানো ডিমের কোর্মা, দেশী মুরগির ঝোল। লিখতে লিখতে আমার মুখে জল চলে এলো।
দ্বিতীয় হতো নারকেলের পিঠে। সে সময় মায়ের সাথে হাত লাগাতো ঠাকুমা আর কাকিমা। এখন ঠাকুমা নেই, কাকিমা বারাসাতে থাকেন। মা বাবা একা থাকে গ্রামের বাড়ি, মাঝে মাঝে আমার ভাই বোনরা যাই। সেকালে আর একালে এই নারকেলের পিঠে বানানোর নিয়ম সেই একই আছে। কয়েকদিন আগে ছোট বোন গিয়েছিল চড়ুইগাছি তে, আমাদের গ্রামের বাড়িতে। মা আর বোন মিলে নারকেলের পিঠে বানিয়েছিল, বোন এই পিঠে বানানোর প্রত্যেক ধাপের ছবি ফেসবুকে আপলোড করেছিল। সেই ছবিই উস্কে দের আমার এই স্মৃতিলেখা কে।
প্রথমেই নারিকেলের খোসা ছাড়িয়ে শক্ত আবরণ দুই ভাগে বিভক্ত করে কুর্নির সাহায্যে নারকেল কুরে নিতে হয়। ছোট বোন ছবি দিয়েছিল, আমি যথা ক্রমে সাজিয়ে দিলাম পোষ্টের শেষে।
তার পরে কড়াইয়ে একটু চিনি আর অল্প জল দিয়ে একটি তরল মিশ্রণ বানিয়ে, তাতে নারকেল কোরা দিয়ে দিতে হবে। একটু খুন্তি দিয়ে নাড়াচাড়া করে অল্প খয়রি করে নামিয়ে নিতে হবে। এর পর ঢেঁকিতে কোটা চালের আটা অল্প গরম জলের সাথে মিশিয়ে খামির বা লেচি বানাতে হবে। এটা আমি বহু বার নিজে নিজে চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোন দিন সফল হয়নি। তার পর গোল গোল লেচি কেটে, হাত দিয়ে ছোট ছোট বাটির মত করে নিতে হবে। বাটির ভিতরে ভাজা নারকেল ছ্যাই বা পুর ভরে, সুন্দর ভাবে মুড়ে দিতে হবে।
এবার ভাপ দেওয়ার পালা। বড় হাড়ি বা কড়াইতে জল গরম করতে হবে। কাঁচা নারকেলের পিঠে একটি বাঁশের তৈরি চুপড়ি বা ঝাঁকাতে সাজিয়ে নিতে হবে। এবার এই ঝাঁকা এমন ভাবে ওই গরম জলের পাত্রের উপরে বসাতে হবে, যাতে সব পিঠের গায়ে গরম বাষ্প সমান ভাবে লাগে। উপর থেকে ঝাঁকা ঢেকে দিতে হবে। আজকাল মোমো যেভাবে বানায়, ঠিক সেই ভাবে, তবে বাসনপত্র অন্য। ভাপের নারকেলের পিঠে তৈরি, ঠাণ্ডা হলে হাউ-মাউ-খাউ।
সেকালের মা এর পিঠে বানানো আর একালে পিঠে বানানোর মধ্যে আমি কোন তফাৎ দেখলাম না। সেই একই আছে, নিয়ম একই, স্বাদ ও একই। এখানে আমার একটা ছোট্ট ঘটনা না উল্লেখ করলে সব বৃথা হয়ে যাবে। আমি ছোটবেলায় ভাবতাম সিঙ্গারা তৈরি করতে হয় না, এমনি এমনি দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। সত্যি বলতে আমি যখন বারাসাতে এলাম, তখন মধু বাবুর মিষ্টির দোকানে প্রথম দেখেছিলাম সিঙ্গারা কীভাবে বানায়। যাই হোক, ছোটবেলায় সিঙ্গারা আর চাটনি খাওয়ার ঘটনা আমি আমার অন্য একটা স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছি, আজ অন্য গল্প বলবো।
যখনি মা নারকেলের পিঠে বানাতো, আমি সর্বক্ষণ মায়ের পাশে পাশে। কোনটার পর কি করতে হয় আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম। একবার যখন বাড়িতে পিঠে হচ্ছে, গোল গোল সাদা লেচি হাত দিয়ে বাটির মত করে তাতে নারকেল ভরা হচ্ছে, মা বলেছিলেন – “সিঙ্গারা খাবি? সিঙ্গারা বানাবো?” আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম – “কী ভাবে?” মা তখন সেই নারকেল ভরা গোল গোল লেচি ঠিক সিঙ্গারার মত করে তিন কোনা করে মুড়ে দিলো, ঠিক যেন সাদা সাদা সিঙ্গারা। আমি তো অবাক!! বাড়িতে সিঙ্গারা? ভাবা যায়!!! মনে আমার টানটান উত্তেজনা, মাথার ভিতরে তখন ঘুরছে গণেশ জননী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের বড় বড় হলুদ হলুদ সিঙ্গারা, ভিতরে বাদাম আর আলু ভরা। আমি মনে মনে বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম, ভাপ দেওয়ার পরে এই সিঙ্গারা রূপি নারকেলের পিঠে হয়তো খেতে সেই দোকানের মতই হবে।
প্রতীক্ষায় সময় আর কাটছে না, কখন ভাপ দেওয়া শেষ হবে আর আমি সিঙ্গারা খাবো। অবশেষে শেষ হয় ভাপ দেওয়া, ঠাণ্ডা কোরা হলো পিঠের ঝাঁকা। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ঝাঁকার দিকে। আমি দেখেছিলাম আমার কল্পনা আর বাস্তবের সাথে অনেক পার্থক্য, বাস্তবে সিঙ্গারা তখনো সাদা, দোকানের মত হলুদ হয়নি। মা দুটো সিঙ্গারা স্টিলের বাটিতে করে আমাকে দিলো। আমি দেরি করলাম না, হাতে তুলেই একটা কামড় বসিয়ে দিলাম। মুখে নিয়েই বুঝতে পারলাম, এটি সিঙ্গারা রূপি নারকেলের পিঠে। তবে যাই হোক, এটা দোকানের সিঙ্গারার মত ঝালঝাল না, কিন্তু এ সিঙ্গারা রূপি পিঠের স্বাদ রাঙিয়ে রেখেছে আমার শৈশবের স্মৃতি।