Share

বন্ধু, তোকে অনেক খুঁজেছি

বন্ধু, তোকে অনেক খুঁজেছি

কৃষ্ণেন্দু ব্যানার্জী, মোটাসোটা চেহারা, গায়ের রং কালো। হয়তো এই গায়ের রংয়ের জন্যই ওর নাম রেখেছিলো হয়েছিল কৃষ্ণেন্দু। ও ছিল আমার ইস্কুলের সহপাঠী, যাকে বলে প্রিয় বন্ধু। ৯০এর দশকের ঘটনা এটা, সব কিছু মনে নেই তবে যতটা মনে আছে তা একেবারে মনে দাগ কেটে আছে। সে দাগ এখন মাঝে মাঝে নখের আঁচড়ে তাজা করে তুলি কোন এক পড়ন্ত বিকালে বা নির্ঘুম রাতে। অনেকে বলে ছোটবেলার স্মৃতি নাকি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত থাকে।

আজ যাকে নিয়ে লিখতে বসলাম, সে আমার বাল্যবন্ধু, সহপাঠী, টিফিন সঙ্গী। গাইঘাটা থানার অন্তর্গত একটি ছোট্ট গ্রাম থেকে, চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে আমাদের পরিবার বারাসাতে চলে এসেছিল ১৯৯০-৯১ এ। বারাসাত শহরের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে আমাকে ভর্তি করা হয়েছিলো। আমাদের অর্ধের পরিবার গ্রামে আর অর্ধেক পরিবার বারাসাত শহরে ভাগ হয়ে গেলো। বাবা, মা আর ঠাকুমা গ্রামেই থেকে গেলো। কাকা, কাকিমা, খুড়তুতো বোন, আমার দিদি আর আমি চলে এলাম বারাসাতে। মা বাবা মাঝে মাঝে আসা যাওয়া করে এ বাড়ি ও বাড়ি। কাকা, কাকীমার এক মেয়ে আর এক ছেলে, ছেলের জন্ম এই বারাসতেই। আমারা তিন জন, দিদি, আমি আর ছোট বোন। মোট এই পাঁচ জন আমাদের যৌথ পরিবারের উত্তরাধারিকারী।

আমি যখন বারাসতে ইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম তখন আমার ছোট বোন আর খুড়তুতো ভাইয়ের জন্ম হয়নি, ওদের জন্ম ১৯৯৩ সালে। তখন পর্যন্ত গ্রামে বাবা, মা আর ঠাকুমা আর এদিকে কাকা, কাকীমা, খুড়তুতো বোন, দিদি আর আমি। শুরু হলো আমাদের বারাসতের বসবাস। আমাদের চলতি বাংলা উচ্চারণে তখনো গ্রামের ছাপ ছিলো। সেই নিয়ে অনেকেই ঠাট্টা করতো। অনেক সাবধানে কথা বলতে শিখলাম বারাসাতে।

স্কুলের নাম ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল হাই স্কুল। নতুন ইস্কুল, সবে মাত্র ৩ বা ৪ বছর শুরু হয়েছে। একটা তিন তলা ভাড়া বাড়িতে আমাদের স্কুল। বারাসাত কলোনী মোড় আর ডাকবাংলোর ঠিক মাঝখানে। একদিকে বারাসাত ইভিনিং /সান্ধ্য কলেজ আর অন্য দিকে বারাসাত ফায়ার ব্রিগেড। প্রথম শ্রেণীতে আমি ভর্তি হয়েছিলাম। সাদা রংয়ের শার্ট আর চকলেট রংয়ের প্যান্ট, এটাই ছিল আমাদের ইস্কুলের ইউনিফর্ম। এই ইউনিফর্ম কেনার একটা নির্দিষ্ট দোকানও ছিল। দোকানের নাম লালমোহন ড্রেস বা বস্ত্রলয়। ইস্কুলের বই খাতা সব ইস্কুল থেকেই কিনতে হতো। এখনো হয়তো কিনতে হয়। আমাদের এই ইস্কুল এখন আর সেই পুরোনো ঠিকানায় নেই। এখন নতুন ঝাঁ চকচকে নতুন ঠিকানা, বারাসাত রোথতলা।

স্কুলের যাওয়া আসা করতাম স্কুলের বাসে। ইস্কুল বাস গোস্বামী ট্র্যাভেলসের, চালকের নাম মনু কাকু। মনু কাকু বেশ ভালো ছিল। মাঝে মাঝে বাসের ভিতরে জায়গা না থাকলে তার চালকের পাসের সিটে আমাকে বসিয়ে নিতো, কারন স্কুল যাওয়ার পথে আমিই শেষে উঠতাম। মেটাডোর কোম্পানির ছোট বাস, ছোট ছোট জানালা আর ভিতরে লম্বা লম্বা সিট, যাতে তিন জন বসা যেতো। স্কুল বাস নাম্বার 4, বারাসাত থেকে হাবড়া ছিল এটির রুট। আমি বাসে উঠতাম কাজীপাড়া রেলগেটের একটু আগে থেকে, আর কৃষ্ণেন্দু আসতো হাবড়ার দিক থেকে। আমার ঠিক মনে নেই ওর বাড়ী কোথায় ছিলো। হয়তো গুমা, অশোকনগর বা হাবড়ায় ছিলো ওর বাড়ী।

১৯৯৩ বা ৯৪ সাল, কৃষ্ণেন্দু আর আমার পরিচয় এই বসেই। একই ক্লাসে আমরা পড়তাম। কয়েক দিনেই আমরা বেশ ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। মাঝে মাঝে স্কুল বাসে ও আমার জন্য পাসের সিট ফাঁকা রেখে দিতো। আবার ফেরার সময় যে আগে উঠবে বাসে সে রেখে দেবে দুটো সিট পাশাপাশি। কৃষ্ণেন্দু গান ভালো বাসতো। মাঝে মাঝেই সে স্কুলবাসে টেপের গানের সাথে সাথে গলা মেলাতো। তখন একটা গান খুব বাজার মাতিয়েছিলো, গায়ক বাবা সাইগাল আর গানের বুলি ছিল, “আজা মেরে গাড়ি মে ব্যাঠ যা, আজা মেরে গাড়ি মে ব্যাঠ যা।

ও একবার গল্প করেছিল আমার সাথে, যে সেবার পূজোয় ওর কাকা বা মামা তাকে কোনো এক বিখ্যাত রেস্তোরেন্টে মোগলাই খাইয়েছিলো। আমার খুব অবাক লেগেছিল। কারণ তখনো পর্যন্ত আমি জানতাম না যে রেস্তোরেন্ট ঠিক কেমন। হোটেল দেখেছি, হোটেলে খেয়েছি তবে রেস্টুরেন্টে কোনো দিন আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়নি তখনো। আর দ্বিতীয় কারণ, আমি কোনো দিন তখনো পর্যন্ত মোগলাই বা মোগলাই পরোটা খাইনি। আমি তখনো পর্যন্ত জানতাম যে খাওয়ার দোকান মানেই হোটেল। রেস্তোরেন্ট আর হোটেলের পার্থক্য তখনও পর্যন্ত জানতাম না।

কৃষ্ণেন্দুর টিফিনে প্রায়দিন থাকতো আটার রুটি আর বাঁধাকপির তরকারী। এই টিফিন আমার কাছে আর একটা চমক। কারণ, আমি জানতাম যে বাঁধাকপি হলো বাড়িতে ভাত দিয়ে খাওয়ার তরকারি। এটি রুটির সঙ্গে যে টিফিন হিসাবে খাওয়া যেতে পারে, আমার কোনো ধারণা ছিল না। টিফিন হিসাবে রুটি আর আলুভাজা বা ডিমভাজা আমার কাছে স্কুলে খাওয়ার উপযুক্ত।

কৃষ্ণেন্দু, স্বপ্নেন্দু, অরিন্দম, আমরা সবাই একই ক্লাসে। একই বাসে স্কুলে যাতায়াত করতাম। সকলের মধ্যেই একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। সময় হুহু করে বয়ে চলে গেলো, আমরাও বড়ো হয়ে গেলাম। হঠাৎ একদিন শুলাম কৃষ্ণেন্দুর বাবা মারা গিয়েছে। কয়েকদিন স্কুলে এলো না। যখন এলো তখন সব সময় চুপচাপ থাকতো কৃষ্ণেন্দু। বেশি কথা বলতো না। হঠাৎ একদিন কৃষ্ণেন্দু হারিয়ে গেলো। তখন অতটা বুঝতাম না, অন্য বন্ধুদের ভিড়ে ওকে ভুলেই গিয়েছিলাম।

একদিন, দুদিন করে কয়েক মাস কেটে গেল। কৃষ্ণেন্দুর আর দেখা পেলাম না। সকলের সাথে আমিও একদিন ভুলে গেলাম ওকে। মাঝে মাঝে ওর কথা মনে পড়লে কান্না পেতো। কোথায় হারিয়ে গেল বন্ধু কৃষ্ণেন্দু। কয়েক বছর পর আবার সেই পুরনো স্মৃতি দাউদাউ করে জলে উঠেছিল। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে আমার কাকার সাথে নাকি কৃষ্ণেন্দুর একবার দেখা হয়েছিল। কৃষ্ণেন্দু কাকা কে চিনতো, ওই এগিয়ে এসে পরিচয় দিয়ে আলাপ করেছিল। ব্যাস! এই টুকুই, তার পর আর কোনো খবর নেই। তখন ফোনের অত চলন ছিল না, বা কাকা অতটা গুরুত্ব দেয়নি এই ঘটনা কে। তাই হয়তো ঠিকানা বা ফোন নম্বর চেয়ে নেয়নি।

আজও মাঝে মাঝে কৃষ্ণেন্দুর মুখের আকৃতি আমি মনে করার চেষ্টা করি, কিন্তু কিছুতেই কিছু মনে আসে না। শুধু এটুকুই মনে আসে, কালো কৃষ্ণেন্দু, মোটাসোটা কৃষ্ণেন্দু, বাবা সাইগেলের গান করতো কৃষ্ণেন্দু। কৃষ্ণেন্দু মনে হয় আমার কথা ভুলে গিয়েছে। ভুলে না গেলে নিশ্চই আমাকে খুঁজতো। ফেসবুকে কত কৃষ্ণেন্দু ব্যানারজীর সাথে আলাপ করে কথা বলে খুজেছি, কিন্তু সেই ছোটবেলার বন্ধু কে খুজে পাইনি। আজ এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আমাকে খুঁজে পাওয়া খুব সহজ। ভাই কৃষ্ণেন্দু, কোন একদিন আমাকে খুঁজে দেখ আমাকে। আমি যে সঞ্জয় হুমানিয়া, এক এবং অদ্বিতীয় এই সোশ্যাল মিডিয়াতে।

সঞ্জয় হুমানিয়া
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বেঙ্গালুরু, ইন্ডিয়া