Share this post:

অনেক বছর আগের কথা, তখন ৯০ এর দশক চলছে। শৈশব আর কৈশোরের টানাপড়ার মধ্যে সময় কাটছে। ছবি আঁকতে ভালবাসতাম, রং তুলি নিয়ে খেলা করতাম। কবে যে কাঠ পেন্সিল আর রং তুলির সাথে প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম, খেয়াল করিনি। পরিবারের ও আঁকার মাস্টারের উৎসাহে বেশ চলছিলো আঁকিবুঁকি। স্কুল, পড়াশুনার মধ্যে ঠিক সময় বেরিয়ে আসতো রং আর পেন্সিল নিয়ে খেলার। বেশ ছিল সেই দিন গুলো, এখনো মাঝে মাঝে চোখ না বন্ধ করেও দেখতে পাই। বেশ কয়েক বছর চললো আমাদের প্রেম প্রীতি। সব ভালো সময়ের যেমন একটা সময় শেষ হয়ে যায়, আমারও হয়ে গেলো।

সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা, মনের মধ্যে ভয়ের মেঘ জমতে শুরু করেছে। কি হয় কি হয় একটা ভাব। মানুষের সব থেকে বেশি ভয় সেই জিনিষে, যে জিনিষ সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ তথ্য জানে না, শুধু মাত্র অর্ধ তথ্য জানে। যেমন ধরুন, একটি শিশু কে যদি ছোটবেলা থেকে ভূতের গল্প শোনানো হয়, তবে সে সারা জীবন ভূতের ভয় পাবে। সে যত বড় হোক না কেন, যতই সে সাহসী হোক না কেন, তেমন পরিস্থিতিতে পড়লে ভূতের ভয়ে একবার হলেও বুকটা অন্তত টিপটিপ করবেই। অন্য দিকে অন্য একটি শিশু কে যদি ছোট থেকেই ভূত সম্পর্কে কোন তথ্য না দেওয়া হয়, তবে কিন্তু সে কোন দিনই ভূতের ভয় পাবে না। আমারা ভয় পাই সেই সবের, যা সম্পর্কে আমরা কম জানি বা অর্ধেক সত্য জানি। যেমন প্রথম কিছু করার আগে সেই কাজের প্রতি ভয়, মাধ্যমিক পরীক্ষা সম্পর্কে ভয়, ভূতের ভয়, মৃত্যু ভয়, নরকের ভয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সব ক্ষেত্রেই আমাদের কাছে অসম্পূর্ণ তথ্য থাকে।

মাধ্যমিকের আগে চারপাশ থেকে এই পরীক্ষা সম্পর্কে অনেক সতর্ক বার্তা পেতে শুরু করি। এটাই জীবনের প্রথম বড় কোন পরীক্ষা, স্বাভাবিক ভাবেই আমিও ভয় পেয়ে একে বারে ল্যেজেগোবরে অবস্থায় পড়লাম। আমার ছবি আঁকা বন্ধ হওয়ার পিছনে এটি একটি কারন, তবে বড় কারন অন্য। আঁকা শেখা এবং আঁকা দুটিই অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো। আবছা একটা কঠোর নির্দেশ পেলাম, ছবি আঁকতে পারবো আবার মাধ্যমিক পরিক্ষার পরে। সেই চিরপরিচিত উক্তি –

“বাবু, এই তো কটা দিন, তার পর তো শুধু মজাই মজা। এখন এই কদিন সব ছেড়ে একটু পড়ায় মন দে!!”

দ্বিতীয় এবং প্রধান কারন আমার এক বন্ধু। ও বড়োলোকের ছেলে, বাপ ঠাকুরদার পৈতৃক সম্পত্তি, ব্যবসা ও নামডাক আছে। বন্ধু হিসাবে খুবই ভালো ছিল। ও ক্রিকেট খেলতো। বারাসাতের পায়োনিয়ার পার্কে একটা ক্রিকেট ক্লাব ছিল, ও সেখানেই ক্রিকেট শিখতো ও খেলতো। আমি ছোট থেকেই কোন খেলাই খেলিনি। ক্রিকেট, ফুটবল, ক্যারাম, ভলিবল বা অন্য কোন কিছুই আমি খেলিনি, খেলতেও পারি না। আমাকে বোঝানো হয়েছিলো,

এই সব খেলার জন্য জীবনে অনেক সময় পাওয়া যাবে, তখন খেলিস, কেউ বারন করবে না।

যাই হোক, বন্ধুর হবি ছিল ক্রিকেট, আর আমি আঁকতাম ছবি। আমাদের দুজনের মধ্যে এই নিয়ে মাঝে মধ্যেই অনেক কথা হতো। প্রথমেই ও নিজের ক্রিকেট ও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে A to Z বলে যাবে, তার পর এই ক্রিকেটের জন্য সে কি কি facility পাবে বা পাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার বর্ণনা। সত্যি বলতে sports কোটায় অনেক সুযোগ সুবিধাও পাচ্ছিলো সে ওই সময়। তার পরে আমার পালা, কিন্তু আমি কি বলবো? ছবি আঁকার তো তেমন কিছু জানতাম না। ছবি এঁকে ভবিষ্যতে যে কি মহান কাজ করা যায় সেটাও আমি জানতাম না সেই সময়।

আমি আমতা আমতা করে শুরু করলে, আমাকে থামিয়ে ও শুরু হয়ে যেত ছবি আঁকার কূফল নিয়ে বলতে। ও বলতো, ছবি এঁকে আমি কোনদিন ক্রিকেটের মত নাম করতে পারবো না। ছবি আঁকা কে কোন sports হিসাবে ধরা হয় না এবং কোটার সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় না। ছবি আঁকা হল total loss. দিনের পর দিন এই একই কথা শুনতে শুনতে আর মাধ্যমিক পরিক্ষার চাপে আমি একদিন সত্যি সত্যি আঁকা ছেড়ে দিলাম। জীবনের ইদুর দৌড়ে  আমি ভুলেই গেলাম যে আমি ছবি আঁকতাম এক সময়, আমিও ছবি আঁকতে পারি!

অনেক বছর পর, যখন সোশ্যাল মিডিয়াতে ছবি আঁকার বাহার দেখলাম, তখন হঠাৎ মনে পড়ে গেলো এই সব কথা। Digital painting, sketch, cartoon এ সব এখনো আমাকে টানে। মাঝে চেষ্টা করেছিলাম এই বয়সে আবার শুরু করার, কিন্তু সম্ভব হল না। খেলাধুলা, ছবি আঁকার সময় মনে হয় এখনো আসেনি, কবে আসবে তাও জানি না। এখন তো শুধুই জীবন যুদ্ধের দৌড়। পেন্সিল হাতে নিলে হাত কাঁপে, কাগজে আঁকিবুঁকি হয় তবে ছবি হয় না। খেলাধুলার আর বয়স নেই, শরীর পারে না। যা কোনদিন করিনি, তা কি আর এই মধ্য বয়সে করা সম্ভব?

সঞ্জয় হুমানিয়া
১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, বেঙ্গালুরু, কর্ণাটক, ইন্ডিয়া

★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★

রংতুলি | Paint & Brush
রংতুলি | Paint & Brush
Share this post:
Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *