হরিপদ স্বপ্ন দেখে—সে দিঘার সমুদ্র সৈকতে সাইকেল চালাচ্ছে। শরীর ও মনজুড়ে শান্তির ছাপ স্পষ্ট। নিশ্চিন্তপুর গ্রাম থেকে কয়েক বছর আগে তার পরিবার মফস্বল শহরে চলে এসেছে। সবাই একটু আধুনিক হতে চায়, সুন্দরভাবে বাঁচতে চায়। কিন্তু হরিপদের মনে কোনো সুখ নেই। সে দিব্যি ছিল নিশ্চিন্তপুরে নিশ্চিন্ত।

আম, জাম, কাঁঠাল, জামরুল, তাল আর নারকেলের বাগানে ঘেরা নিশ্চিন্তপুরের বাড়ি—পৈতৃক সম্পত্তি, যা তার ঠাকুরদা তৈরি করেছিলেন। মাটি থেকে কোমর পর্যন্ত উঁচু বারান্দা, লাল রঙের মেঝে, বারান্দায় ওঠার জন্য বড় ধাপ। পাশাপাশি দুটি ঘর, বড় কালো কাঠের দরজা আর জানালা। জানালায় মোটা লোহার গরাদ—জেলখানার মতোই।

বাড়ির ডান পাশে খিড়কির দরজা। দরজা পেরোলে জামরুলতলা, তারপরই মস্ত পুকুর। পুকুরের চারপাশে আম-কাঁঠালের বাগান। কোনো বাগানের নাম কলম বাগান, কোনোটা জলের বাগান। ছিল বেলতলা আর জামতলা। এই সব নিয়ে হরি বেশ ছিল। মায়ের কড়া শাসন আর ঠাকুমার আদরেই সে বড় হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ সবাই আধুনিক হওয়ার ধান্ধায় শহরে চলে গেল। বাগান ঘেরা বাড়ি ছেড়ে উঠল নিচু ছাদের ছোট দুই কামরার ১২ বাই ১২ ঘরে।

সুখ চিরকাল সকলের জীবনে থাকে না। হরি এই নতুন জীবনের সাথে তাল মেলাতে হাপিয়ে উঠল। কিন্তু তার এই পরিশ্রম কারো নজরে পড়ল না—এটাই স্বাভাবিক। হরির কথা, ব্যবহার, জীবনধারা সবই গ্রামীণ। স্কুল, পাড়া আর বাড়ি—এই তিন জগতে হরি ছিল একা। তিনটি জগতে তাল মেলাতে গিয়ে বহুবার হেনস্তা হয়েছে, মানুষের হাসির পাত্রও হয়েছে। কিন্তু সে হার মানেনি। নিজেকে আলাদা আলাদা জগতের মতোই তৈরি করেছিল।

হরি বড় হলো। এবার সাইকেল চালানো শেখার পালা। বাজারে তখন সোজা হ্যান্ডেলের সাইকেল এসেছে। হরি স্বপ্ন দেখে দিঘার সৈকতে সাইকেল চালানোর। একদিন বাবা’কে স্বপ্নের কথা জানাল। কিন্তু বাবার এক কথায় তার স্বপ্ন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল।

বাবার ধারণা—সোজা হ্যান্ডেলের সাইকেল চালালে হৃদরোগ হয়। আর দ্বিতীয় কারণ, বাবার সৌন্দর্যের প্রতি তীব্র অনীহা। যেমন ধরুন, স্কুলের জলের বোতলের বদলে বাইক বা গাড়ির ইঞ্জিন অয়েলের বোতল ব্যবহার করলে বাবা খুশি হন। হরির মন ভেঙে গেল। সে বুঝল—এই জন্মে তার সোজা হ্যান্ডেলের সাইকেল চালানো হবে না। কারণ, বাবা একবার যা ভাবেন, সেটাই করেন। হাজার যুক্তি দিলেও কিছু হবে না।

হরির কপালে জুটল Avon কোম্পানির লাল রঙের ছোট একটা বাংলা সাইকেল। কপালের লিখন ভেবে মেনে নিল সেদিন। শৈশব, কৈশোর আর যৌবন সে কাটিয়ে দিল এই সাইকেলে। জীবনে কোনো সোজা হ্যান্ডেলের সাইকেলকে সে ঢুকতে দেয়নি। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়, পাড়ার ছেলেরা অনেকেই নানা সময়ে সোজা হ্যান্ডেলের সাইকেল নিয়ে এসেছে, কিন্তু হরি কখনো তা ছুঁয়ে দেখেনি।

সময় পাল্টেছে। হরি এখন মধ্য বয়সী। সে আর সাইকেল চালায় না। তার হৃদরোগ হয়নি। সে বাবার অমতে দুটি বাইক কিনেছে—দুটোরই হ্যান্ডেল সোজা। আর সেই ছোট লাল সাইকেলটা এখন বাবা মাঝেমধ্যে চালান। হরি বহুবার একটা ভালো সাইকেল কেনার কথা বলেছে। কিন্তু বাবা তখনই লাল সাইকেলটা মুছে বলেন, “এটা তো নতুন সাইকেল, দিব্যি চলছে।” হরি আর কিছু বলে না। বাবার কথা মানেই চূড়ান্ত।

একদিন দুপুরে হরি বাড়িতে বসে অফিসের কাজ করছিল। বাড়ির সামনে একটা পুরনো সোজা হ্যান্ডেলের সাইকেল দাঁড়িয়ে। অবাক হয়ে সে বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, “এটা কার সাইকেল?” বাবা কাছুমাছু মুখে বললেন, “সস্তায় পেয়েছি, তাই কিনলাম। খুব ভালো সাইকেল, চালিয়ে আরাম। মাত্র ৫০০ টাকায় পেয়েছি।”

হরি জানত, এ সাইকেল ৫০০ টাকায় কেউ বিক্রি করেনি। বাবা আসল দাম কখনো বলবেন না। হরি একটু চালিয়ে দেখল—সাইকেলটা বেশ ভালো। শৈশবের স্বপ্ন আর ইচ্ছের কথা মনে পড়ল। হরির মনে হলো—সব কিছুরই একটা বয়স থাকে। বয়স পেরিয়ে গেলে অনেক ইচ্ছেই অপূর্ণ থেকে যায়। আজ আর এই সোজা হ্যান্ডেলের সাইকেল নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই। বাবা যখন বারান্দায় বসে সাইকেলের গুণগান করছিলেন, হরি হেসে বলল, “দেখো আবার, এই সাইকেল চালিয়ে তোমার হৃদরোগ না হয়ে যায়!”

তথ্যসংযোজন:

সোজা হ্যান্ডেলের সাইকেল চালানোর সাথে হৃদরোগের কোনো বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক নেই। হৃদরোগের কারণ সাধারণত জীবনধারা, খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, এবং পারিবারিক ইতিহাসের উপর নির্ভর করে।

তবে সাইকেল চালানো একটি ভালো কার্ডিওভাসকুলার ব্যায়াম, যা হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। সঠিক ভঙ্গিতে এবং নিয়মিত ব্যায়াম করলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো যেতে পারে। তাই ভুল ধারণায় কান না দিয়ে সঠিক তথ্য জানাই ভালো।

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *