ছোটবেলায় আমরা প্রায় সকলেই স্কুলের বিজ্ঞান বইয়ে পড়েছিলাম যে, বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু আবিষ্কার করেছিলেন যে গাছেরও প্রাণ আছে। উদ্ভিদও যে তাপ, শীত, আলো, শব্দ ও অন্যান্য অনেক বাহ্যিক উদ্দীপনায় সাড়া দিতে পারে, তা তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। এই প্রমাণের জন্য তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন ক্রেস্কোগ্রাফ (Crescograph) নামক একটি বিশেষ যন্ত্র। যাই হোক, আজ বিজ্ঞানের কথা লিখতে বসিনি, আজ লিখতে বসেছি আজগুবি এক অভিজ্ঞতা ও একটি কানা বেগুনের আত্মজীবনী। লকডাউনে ঘরে বসে বেশ লাগছে ইনিয়ে-বিনিয়ে ঝুড়িঝুড়ি আজগুবি লেখা লিখতে। জানি না কেউ পড়বে কিনা, তবে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি নিজের জন্য লিখি।

উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা থানার অন্তর্গত একটি ছোট্ট গ্রাম, গ্রামের নাম চড়ুইগাছি। যারা শহরের এবং একালের মানুষ, তারা হয়তো চিনবেন না। সেকালের মফস্বলের মানুষ হয়তো চিনতে পারবেন। এটি সেই গ্রাম, যেখানে ১৯৮৩ সালের ১২ এপ্রিল, মঙ্গলবার (২৮শে চৈত্র ১৩৮৯) এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় তাণ্ডব করেছিল। যাই হোক, গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার শেষের দিকে ধান ও সবজি চাষের জমি ছিল। এখানেই এক চিলতে জমি ‘বেঁকা-ভুঁই’ নামে পরিচিত। আমার জন্ম এখানেই। ছোটবেলা থেকে ভূমির মালিক আমার লালনপালনে কোনো ত্রুটি রাখেনি। পর্যাপ্ত জল, হাওয়া ও রোদ পেয়েছি, মাঝে মাঝে পেয়েছি উৎকৃষ্ট মানের জৈব ও রাসায়নিক সার। কোনো ক্ষেত্রেই আমাদের ওপর টাকা পয়সা খরচ করতে মালিক কার্পণ্য করেননি। আমি অন্য সব বেগুনের সঙ্গে তরতরিয়ে বেড়ে উঠছিলাম। ‘বেঁকা-ভুঁই’ ঘেরা ছিল বাঁশের বেড়া দিয়ে, যাতে মানুষ বা অন্যান্য পশু আমাদের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। আমাদের পাশের খেতে বেগুন গাছ ছিল, তবে তাদের তেজ আমাদের মতো ছিল না। আমরা রূপে-গুণে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলাম অন্য বেগুনের চেয়ে।

কিন্তু সুখ চিরস্থায়ী হয় না। কোথা থেকে এক দল পোকা এলো আমাদের বেঁকা-ভুঁইয়ে। সেটা এক মহামারীর রূপ নিল। মালিক খরচের দিকে কার্পণ্য করলেন না। প্রচুর পয়সা ঢেলে নামীদামী কীটনাশক ব্যবহার করলেন আমাদের সুস্থ করে তুলতে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত চলল আমাদের সুস্থ করার কাজ। অবশেষে প্রায় সবাই এই মহামারী থেকে রক্ষা পেল, কিন্তু আমরা কয়েকজন আর সম্পূর্ণ ঠিক হতে পারলাম না। আমি কানা বেগুন হয়ে গেলাম। কানা হয়েছি বলে একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নই, খুব ভালো করে দেখলে তবেই বোঝা যাবে যে আমি কানা বেগুন। কোথায় যেন শুনেছিলাম, পোকা সেই ফল ও সবজিকে আক্রমণ করে, যারা সাধারণের থেকে একটু ভালো হয়। এই মনোভাব নিয়ে এগিয়ে চলছিলাম। আমরা যৌবনে পা দিলাম। এবার নিজের মূল্য যাচাই করার সময় এলো। সবজি হাটে নিয়ে যাওয়ার দিন এগিয়ে এলো।

সপ্তাহে দু’দিন হাট বসে, বৃহস্পতিবার আর রবিবার। আমাকে আলাদা করা হলো না, অন্যান্য বেগুনের সাথেই আমাকে একই ঝাঁকায় সাজানো হলো। আমার চকচকে দিকটা উপরের দিকে রাখা হলো, যাতে প্রথম দর্শনে বোঝা না যায় যে আমি কানা বেগুন। বৃহস্পতিবারের হাটে লোকে লোকারণ্য, ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বক্সীগঞ্জের পদ্মাপারের হাট’। উচ্ছে, বেগুন, পটল, মুলো, বেতের ধামা-কুলো, সর্ষে, ছোলা, ময়দা, আটা—সবকিছুই হাটে মেলে। হাটের সেরা বেগুন আমরাই, প্রথম দু’ঘণ্টায় তা বুঝে গিয়েছিলাম। হুহু করে ঝাঁকা ফাঁকা হতে শুরু করলো। আমাদের নিয়ে কোনো দরদাম হয় না। মুস্কিল হলো কিছুক্ষণ পরে। ঝাঁকা প্রায় ফাঁকা। প্রথম থেকেই আমি এর-ওর হাতের আঙুলে ঝুলে পড়ার চেষ্টা করছিলাম। একটু পরে বুঝতে পারলাম, আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে একের পর এক গ্রাহক। চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করলো আমার কপালে। এভাবে চলতে থাকলে আমি তো গরম ভাতের ওপর বেগুন ভাজা বা তেলাপিয়া মাছের সঙ্গে বেগুনের সবজি হতে পারবো না!

এ আমার অস্তিত্বের লড়াই। বেগুন হয়ে জন্মে যদি ভাজা, পোড়া বা তরকারি না হতে পারি, তবে তো এ ভীষণ লজ্জার। হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতার এই বাজারে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম। কোনো মতে আমাকে কারো হাতে ঝুলে পড়তেই হবে, আমাকে কোনো একজনের বাজারের থলির মধ্যে যেতেই হবে। এখন আর গ্রাহকের মুখ আর পোশাক দেখার সময় নেই, যে কেউই হোক, একজন হলেই চলবে। দিনের আলো নিভে গিয়ে সন্ধ্যায় হলুদ মিটমিটে বিদ্যুৎ বাতি জ্বলল, হাট হাল্কা হয়ে আসছে। আমি তখনো ঝাঁকায় পড়ে আছি আর কয়েকটি বেগুনের সঙ্গে। জীবনের এই প্রথম হাট। সকলের জীবনে একটাই হাট আসে, এই হাটেই যে যার মূল্য বুঝে যায়। হাটে বিক্রি না হলে কী পরিস্থিতি হবে, সেটা আমার জানা ছিল না। দুশ্চিন্তা মনের মধ্যে কালো মেঘের মতো জমতে শুরু করলো। এবার কি হবে? কী আমার ভবিষ্যৎ? জীবনে কি সাফল্য আসবে না তাহলে?

ঝাঁকা প্রায় শেষ। লজ্জায় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে ব্যর্থ, পড়ে আছি ঝাঁকার এক কোনায়। সবজি বিক্রেতা হাঁটু মুড়ে বসে টাকা গুনছে। আজকের বেচাকেনায় ভালোই লাভ হয়েছে। সবজিওয়ালা মাথায় গামছা খুলে মুখ মুছলো। এবার তাকে ঘরে ফিরতে হবে। উঠে দাঁড়িয়ে এক হাতে ঝাঁকা তুলে নিলো আর অন্য হাতে আমাকে। ঠোঁটের কোনে গুনগুন করে গাইতে শুরু করলো, “লোকা লোকা লোকা হানি সিং”। আমি একটু নিশ্চিন্ত হলাম, মনে হলো শেষমেশ সবজিওয়ালার হাড়িতেই যেতে হবে। খারাপ কী! সেও তো মানুষ। যার যেখানে ভাগ্য তাকে তো সেখানেই যেতে হবে। এসব সাতপাঁচ ভাবছিলাম আর মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম। কিন্তু বিধাতা যে ওপর থেকে মুচকি হাসছেন, সেটা আমরা কেউই দেখতে পাই না। আমরা সকলেই তার খেলার পুতুল। তার ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটি পাতাও হাওয়ায় দোলে না।

ভবের এই খেলাঘরে খেলে সব পুতুল খেলা, জানি না এমন খেলা ভাঙে কখন কে জানে, বানাইয়াছে পুতুল যিনি, একদিন ভাঙবে তিনি, কে জানে কোন খেলাতে ভাঙে পুতুল আপন মনে।

হাট পেরিয়ে পাকা রাস্তা, পাকা রাস্তার ওপার থেকে শুরু হয়েছে পায়ে হাঁটার কাঁচা রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে একে বেঁকে গেলেই আমাদের গ্রাম। গ্রামের শেষ প্রান্তে ‘বেঁকা-ভুঁই’, আমার জন্মস্থান। বুকের ডান দিকে ভাঙা মন আর চোখের কোনে শুকিয়ে যাওয়া জল এই মুহূর্তে এটাই সম্বল। মনে মনে ভাবছি, আমি কি তেলে ভাজা হবো? নাকি তেলাপিয়া মাছের সঙ্গে তরকারি হবো? আবার মন চায় কাঁচা পেঁয়াজ আর লঙ্কার সঙ্গে মিশে বেগুন পোড়া হতে। হঠাৎ আমার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটল। সবজিওয়ালা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো হাটের শেষ কোণে। আলো-আঁধারিতে আমাকে একবার নিজের চোখের কাছে এনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। বুকের ভেতরটা তোলপাড় করছে হৃদস্পন্দনে। সবজিওয়ালা দু’বার চুকচুক শব্দ করে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল হাটের কোণে আস্তাকুঁড়ে, অন্য পচা সবজির মধ্যে।

ভোর হলো, হাট ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই। কাল রাত পর্যন্ত এখানে যেন মেলা বসে ছিল, আর আজ খাঁ খাঁ করছে। পরবর্তী হাট বসবে আগামী রবিবার। আপাতত তখন পর্যন্ত নিজের মূল্যায়ন সম্পূর্ণ হলো। ক্লান্ত চোখে আমি মুখ থুবড়ে পড়ে আছি। দূর থেকে ঘণ্টার শব্দ ভেসে এলো। মন্দিরের ঘণ্টা নয়, অনুমান করলাম, কোনো এক গরুর গলায় বাধা ঘণ্টা। হেলেদুলে হেঁটে আসার ছন্দে বেজে ওঠা ঘণ্টাধ্বনি। এমন ঘণ্টার শব্দ আগেও অনেক শুনেছি। আমাদের সবজি খেতের পাশ দিয়ে নাঙল কাঁধে নিয়ে কত গরু মাঠে যেত। দূর থেকে একটু একটু করে কাছে আসতে শুরু করল সেই ঘণ্টার শব্দ। কয়েক মিনিট পর আমি গরুটিকে দেখতে পেলাম। রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে এদিক-ওদিক মুখ লাগিয়ে খুঁজছে, খাবার কিছু আছে কি না। আস্তাকুঁড়ের কাছে এসে তার লম্বা জিভ দিয়ে একবার নাকের উপরের মাছি তাড়ালো। লেজ নাড়তে নাড়তে সেই ধীরস্থির গতিতে আমার দিকে এগিয়ে এলো।

নিজের অজান্তেই আমি দীর্ঘশ্বাস নিলাম। সবই কপাল, কার কোথায় মুক্তি, তা কেউ জানে না। এখন আর কোনো গ্লানি নেই মনে, চোখের কোনেও জল নেই। কপাল ভালো আমার, এই আস্তাকুঁড়ে পচে মরতে হলো না। অন্তত একটি গরুর ক্ষুধা মেটাতে সক্ষম হলাম। এভাবেই একটি কানা বেগুনের আত্মজীবনী শেষ হলো।

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *