আমার শৈশবের অমাবস্যা মানেই এক ভয়ের গল্প, যার ছায়া আজও স্মৃতির জানালায় থমকে আছে। তখন ৮০’র দশকের শেষ দিক, আমাদের পাড়াগাঁয়ে বিদ্যুৎ তখনও আসেনি। সন্ধ্যা নামলেই অন্ধকার নেমে আসত এক অলিখিত আতঙ্ক নিয়ে। আর তার ওপর কালীপূজোর অমাবস্যা—আমাদের ছোট্ট মন তখন ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিলো যে এটা “গলাকাটা অমাবস্যা”।
সেই অমাবস্যা এলে মা আমাদের ডান হাতে সাদা সুতো দিয়ে বাঁধিয়ে দিতেন এক টুকরো শিকড়—এক ধরনের চুল-কাটা গাছের শিকড়। সেই শিকড় আমাদের রক্ষা করত। রক্ষা করত এক অদৃশ্য ভয় থেকে, যা আমাদের মনে জন্ম নিয়েছিল গল্পে, গুজবে, আর বয়স্কদের চোখেমুখে লেখা আতঙ্কে। সেই শিকড় দিতেন এক প্রতিবেশী বৃদ্ধা—চুপচাপ, ধীরকান্তি, যেন তিনিই গ্রাম্য জাদুবিদ্যার এক জীবন্ত বই।
গ্রামের বড়োরা বলতো, ওই রাতে কিছু লোক গ্রামে ঘোরে—তারা ভালো মানুষের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায়, আর সুযোগ পেলেই বাচ্চাদের চুল কেটে নেয়। যার চুল কাটবে, সে নাকি রক্ত বমি করে মরবে। আমরা চোখ বড় বড় করে সেই গল্প শুনতাম আর কল্পনায় এক ভয়ংকর তান্ত্রিকের মুখ এঁকে ফেলতাম।
সেই রাতে আমবাগানে যাওয়া নিষেধ, জামরুল গাছের নিচে দাঁড়ানোও মানা। বুক কাঁপত, মনে হতো—এই বুঝি কেউ ঝোপের আড়াল থেকে এসে কাঁচি দিয়ে ‘কচ’ করে আমার চুল কেটে নেবে। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলতাম, “মা, শিকড়টা বাঁধো তো…” শিকড় বাঁধার পর একটা আশ্বাস, একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস—আমি আজ রক্ষা পেলাম।
কিন্তু ভয় এখানেই থামত না। বিকেলের পর ছড়িয়ে পড়ত আরেক আশঙ্কা—যদি আজ রাতেই পায়খানা পায়? শোনা কথা ছিল, আজ রাতে যদি কারো পায়খানা পায়, তবে সারা জীবন তাকে রাতেই পায়খানা পাবে। সে চিন্তায় গা শিউরে উঠত।
তখন আমাদের পায়খানাঘর ছিল বাড়ির বাইরে, জামরুল গাছ আর পুকুরের পাশে। সন্ধ্যার পরে যেতে হলে হ্যারিকেন হাতে বেরোতে হতো। লম্প থাকত, কিন্তু তার আলো ছিল বিশ্বাসঘাতক—একটু হাওয়া এলেই নিভে যেত। তখন বুক ধড়াস করে উঠত। মনে হতো, সত্যিই কি হাওয়া? নাকি কেউ অদৃশ্য ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলো?
এইসব ছোট ছোট ভয়ই গেঁথে আছে আমার শৈশবের অমাবস্যা রাতগুলোয়। এখন অবশ্য সবটাই স্মৃতি। বিদ্যুৎ এসেছে, ভয় পালিয়েছে। কিন্তু মাঝেমাঝে এখনো মনে হয়—হয়তো কোনো এক অলৌকিক সন্ধ্যায়, হ্যারিকেনের আলোয় টিমটিম করে জ্বলে উঠবে সেই শিকড় বাঁধার গল্প…
সঞ্জয় হুমানিয়া
অক্টোবর ২৭, ২০১৯ – বেঙ্গালুরু
★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★