কোথা থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। মানুষের মন মাছ ধরা জালের মতো। জালে জল ধরা যায় না, তবে বড় বড় মাছ ধরা যায়। জল হলো সময়ের মতো, আর এই সময় জলের স্রোতের মতো বয়েই চলে। বড় বড় মাছ হলো সময়ের স্রোতের মাঝে ছোট ছোট ঘটনা। আর মাছ ধরা জাল হলো আমাদের মন। এই জালেই ধরা পড়ে কত স্মৃতি, কত অভিজ্ঞতা, কত ঘটনা, কত মুহূর্ত।

অতি সাধারণ অনেক ঘটনাই আমাদের মনে গভীর ভাবে দাগ কেটে যায়। প্রথম প্রথম আমি ভাবতাম হয়তো এমনটা শুধু হয়তো আমার সঙ্গে ঘটে। কিন্তু পরে বুঝছলাম সকলের সাথেই এটা ঘটে থাকে, এটি একটি প্রকৃতির সাধারণ নিয়ম। প্রথম বয়লার মুরগীর মাংস খাওয়া, প্রথম সয়াবিন বাড়ির তরকারি খাওয়া বা প্রথম প্রেশার কুকারের রান্না, সব যেন কেমন করে মনে আঁচড় দিয়ে গিয়েছে। বাবা কাকার মুখে তাদের শৈশবের গল্প শুনেছি। শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, স্মৃতি বড্ড মধুর সম্পদ। এ সম্পদ কেউই হাত ছাড়া করতে চায় না। এই সম্পদ যে যত নাড়াচাড়া করবে, ততই বাড়বে।

গ্রামের ছেলে আমি। ছোটবেলা থেকেই দেশী মুরগি, হাঁস, রাজ হাঁস, পায়রার মাংস ও ডিম অতি সাধারণ বস্তু ছিল আমার জীবনে। সব কিছুই হাতের কাছে ছোট থেকে। অবাক হয়েছিলাম সেদিন, যেদিন প্রথম বয়লার মুরগি দেখেছিলাম। সাদা ধপধপে মুরগি, গায়েগতরে বেশ, স্বভাবে শান্তশিষ্ট। যেখানে খুশি বসিয়ে দাও, কথাও পালিয়ে যাবে না দেশী মুরগির মতো। ছোটবেলায় সারাদিন একটু বেশি দৌড়োদৌড়ি করলে আমার ঠাকুমা বলতো –

“মুরগির পায় জিরেন আছে, তবে তোর পায় নেই!”

কিছুদিন আগে ফেসবুকে পরিচয় হয় এক অজানা মানুষের সাথে। ইচ্ছা হয়েছিলো কথা বলতে, টেক্সট করে চ্যাট করলাম। বেশ ভাল লাগলো। আমি বন্ধু হিসাবে ফেসবুকে জড়িয়ে নিলাম। এই ঘটনার কয়েকদিন পরে এই বন্ধুর ফেসবুক দেওয়াল থেকে একটা তার লেখা ছোট প্রবন্ধ চোখে পড়লো। অতি সামান্য একটা ঘটনা কেন্দ্র করে কয়েক লাইন লেখা। লেখাটা এখানে তুলে ধরলাম।

সুতো দিয়ে ডিম অর্ধেক করে কাটার সাথে অতীতের নিম্নবিত্ত পরিবারের লোকজন বেশ পরিচিত থাকবেন। এছাড়া গোটা ডিম কেটে মশলা দিয়ে খাওয়ার আলাদাই মজা৷

কলেজবয়সে মাঝেমধ্যে বেলঘরিয়া স্টেশনে ব্রীজের নিচে ডিম খেতাম পাঁচটা ছটা করে। সুতো দিয়ে ডিম কেটে মশলা দিয়ে শালপাতায় দিতেন দোকানদার কাকু।

তখন বেশ দুষ্টু ছিলাম। বলতাম – কাকু আড়াই পোঁচে কাটবেন, আমি কিন্তু মুসলমান!

আজ সকালে উঠে কি খেয়ালে দুধ আর ডিম কিনে আনলাম। আজ জলখাবার হবে এক গ্লাস গরম দুধ আর ডিম সেদ্ধ দিয়ে। ডিম সেদ্ধ খাওয়ার সময় প্রথমেই সদ্য পরিচিত ফেসবুক বন্ধু সেখ সাহেবুল হক এর কথা মনে পড়লো। হাতে ফোন নিয়েই স্ক্রোল করে ওর এই লেখাটা একবার পড়ে নিলাম। হাতের কাছে শালপাতা নেই, সুতোও নেই। কি হবে এবার? আমার তো খুব ইচ্ছা করছে নিজেকে সেই বেলঘরিয়া স্টেশনে ব্রীজের নিচে ডিমের দোকানে বা বারাসাত স্টেশনে চার নম্বর প্লাটফর্মের সেই দোকানে দাড়িয়ে ডিম খেতে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ নিজেকে এই পুরনো আবছা স্মৃতির মধ্যে দাড় করিয়ে ফেললাম। এবার আমি সেই ফেলে আসা দিনের চরম মজাটা আজ নিতে চলেছি। শালপাতার বদলে সাদা কাগজ আর সুতোর বদলে ছুরি, এতাই পার্থক্য। 

নাহ! তেমন তৃপ্তি পেলাম না। কানে আসছে না সেই  স্টেশনের মায়াবী আওয়াজ। কোথায় যেন পড়েছিলাম, একটা যেকোনো অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক কিছু। যেমন স্থান, কাল, আবহাওয়া, চারপাশের পরিস্থিতি  ও অনেক অজানা বৈশিষ্ট্য। অতীত কে recreate করা যায় না। স্মৃতিকে উস্কে দেওয়া যায় তবে একই রকম ভাবে পুনরাবিত্তি করা যায় না। কিছু না কিছু কম পড়েই যায়। স্মৃতি কে শুধু মাত্র মনের গভীরে জীবিত রাখতে হয়। স্মৃতি বড্ড মধুর সম্পদ। এ সম্পদ কেউই হাত ছাড়া করতে চায় না। এই সম্পদ যত নাড়াচাড়া করবে, ততই বাড়বে।

সঞ্জয় হুমানিয়া
০৯ অগাস্ট ২০১৮, বেঙ্গালুরু, ইন্ডিয়া

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *