বাবার পিছনে বসে, দুহাত দিয়ে জড়িয়ে বসে থাকতাম মোটরসাইকেলে। রয়েল এনফিল্ড, বুলেট, ৩৫০ সিসি, ডান পায়ে কিক স্টার্ট, ডান পায়েই গিয়ার বক্স, বাম পায়ে ব্রেক, ৮০-৮৫ এর মডেল, কালো রঙের। সময়টা ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪-৯৫, গ্রামে একটাই মোটর সাইকেল। কর্ম সুত্রে বাবা এই মোটরসাইকেলেই নদিয়া, মুরশিদাবাদ, হাওড়া, দক্ষিন ২৪ পরগানা চষে বেড়িয়েছে। সত্যিই চষে বেড়িয়েছে, আমাদের তখন ট্র্যাক্টর এর ব্যবসা ছিল। উত্তর ২৪ পরগনার আশেপাশের জেলাতে তখন তেমন ভাবে ট্রাক্টর ছিল না। আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নতির পিছনে এই ব্যবসা বড় অবদান ছিল। ট্র্যাক্টর এর ব্যবসা আজ অচল, আর সেই রয়েল এনফিল্ড বুলেটও নেই।
যে দিন থেকে আমি নিজেকে জানি, সেদিন থেকেই দেখেছি এই রয়েল এনফিল্ড, বুলেট কে। ছোটবেলায় খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম প্রত্যেকটা জিনিস। আজ এই মধ্য বয়সেও সেই সব স্মৃতি তাজা হয়ে আছে। বাবা মা এর সাথে আত্মীয়দের বাড়িতে যাওয়া, কেনাকাটার জন্য বাজারে যাওয়া কিম্বা ঘুরতে যাওয়া, সব কিছুর সঙ্গী ছিল এই রয়েল এনফিল্ড, বুলেট। বহুবার এই গাড়িতে মামার বাড়ি গিয়েছি। দাদু দিদিমা আর গ্রামের লোক আমাদের আগমন বার্তা পেয়ে যেত অনেক আগে থেকে। ফাকা মাঠ আর মাছ চাষের বড় বড় ঘেরির ঠিক মাঝখান দিয়ে রাস্তা। প্রায় ২ কিলোমিটার কাঁচা মাটির রাস্তা, তার পর আমার মামা বাড়ি। গ্রামের নাম তেহাটা। রয়েল এনফিল্ড বুলেট ৮০ এর মডেলের আওয়াজ একটু বেশীই গম্ভির ছিল। ফাঁকা যায়গা হলে অনেক দূর থেকে শুনতে পাওয়া যেত, ভট! ভট! ভট! ভট। ধরুন রাতে আমারা বাড়িতে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছি হঠাৎ ঠাকুমা আমার মা কে ডেকে দিয়ে বলল, “ মা ওঠ, খোকা বাড়ি আসছে”। বাবা যখন যশোর রোড থেকে আমাদের গ্রামের কাঁচা রাস্তায় নামতো, তখন থেকেই রয়েল এনফিল্ড বুলেট এর আওয়াজ শোনা যেত আমাদের বাড়ি থেকে। দিনের বেলা অবশ্য শোনা যেত না, শুধু রাতেই শোনা যেত।
আমার এখনো মনে আছে, কোন একটা দরকারে আমরা বারাসাত এসেছিলাম। তখন বারাসাতের নুতুন বাস স্ট্যান্ড হয়নি, বাস স্ট্যান্ডের সাথে জুড়ে আছে যুবক সংঘ ক্লাব আর তার ভলিবল মাঠ। সেদিন প্রথম দেখেছিলাম ভলিবল খেলা। এমন অনেক ছোট ছোট টুকরো টুকরো ঘটনা এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। একবার বাইকে কিছু একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল, গ্যারেজে দেওয়া হয়েছিল ঠিক করানোর জন্য। একদিন আমি আর বাবা গ্যারেজে গিয়ে দেখি বাইকে কাজ চলছে, আর বাইক লন্ড ভন্ড করে খুলে রাখা আছে। এই দৃশ্য দেখে আমার চোখ ছলছল করে উঠেছিল। আমি তখন অনেক ছোট, শুধু ভাবছিলাম যে, ভালো বাইক বাবা গ্যারেজে দিয়ে গেলো আর মিস্ত্রীরা সেটা খুলে লন্ড ভন্ড করে ফেলেছে। মনে হচ্ছিল যে, যদি মিস্ত্রীরা আর ঠিক করতে না পারে? তবে কি হবে?
শেষবার আমি বাবার সঙ্গেই এই বাইকে চড়েছিলাম গ্রামের বাড়ি থেকে আমাদের বারাসাত এর বাড়ি আসার সময়। হাবড়া পার করে আমরা আসছি, হঠাৎ একজন হাত দেখিয়ে আমাদের থামিয়ে দিলেন। রাস্তার পাসের একটা ছোট ব্যাটারির দোকান, যেখানে চার চাকা, ছয় চাকা বা বাইকের ব্যাটারি বিক্রি করা হয়। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকটি ছোট বড় গাড়ির গ্যারেজ। যে আমাদের কে দাঁড় করিয়েছিল, সম্ভবত সে সেই ব্যাটারির দোকানের মালিক বা কর্মচারী। তার দাবি অনুযায়ী কোন এক সময় আমরা আমাদের ট্র্যাকটারের জন্য ব্যাটারি কিনেছিলাম, এবং সেই বাবদ কিছু টাকা বাঁকি ছিল। এই বাঁকি টাকার ব্যাপারে বাবার কিছুই মনে নেই। তাদের কাছেও কোন লিখিত বিল বা চালান নেই, শুধুই মৌখিক দাবি। তারা রীতিমতো ঝাঁজিয়ে কথা বলছে, আর বাবা যতটা সম্ভব ভদ্র ভাবে কথা বলছে। বলতে গেলে আমাদের কে আমাদের বাইক সহ আটক করেছিল। আমি নিরুপায় করুন মুখ নিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে সব দেখছি। শেষমেশ বাবা টাকা দিতে রাজি হয়ে গেলো, কিন্তু সেই সময় কাছে টাকা ছিল না। বাবা বলেছিল আগামী কাল এসে টাকা দিয়ে যাবে, কিন্তু তারা তা শুনতে নারাজ। তখুনি চাই তাদের পাওনা টাকা। কোন উপায় না পেয়ে আমাকে আর বাইক রেখে টাকার খোঁজে বাবা চলে গেলে কোন এক পরিচিত লোকের খুজতে। সে এই আশেপাশের গ্যারেজেই থাকে হয়তো। মিনিট ৩০-৩৫ এর মধ্যে ফিরে এসে বাবা টাকা মিটিয়ে দিলো। আমার তখন চোখ ছলছল করছে, নিজেকে খুব নিরুপায় লাগছিলো। হয়তো বাবা বুঝতে পেরেছে আমার অবস্তা, কিন্তু সামনে কিছু বললো না। আমরা আবার যাত্রা শুরু করেছিলাম বারাসাতের দিকে।
আমার যতদূর মনে পড়ে, এই ঘটনার পর বারাসাতের বাড়িতেই বেসির ভাগ সময় পড়ে ছিল রয়েল এনফিল্ড বুলেট। পড়ে থাকার পিছনে অন্য কারন ছিল। এই সময় বাবা বেসিরভাগ সময় বাইক ব্যাবহার না করে স্কুটার ব্যাবহার করতো, আমাদের একটা বাজাজের স্কুটার আছে। তার পর বহু বছর কেটে গেলো, রয়েল এনফিল্ড বুলেট সেই একই জায়গায় দাড়িয়ে। আমি নিজে কোন দিন এই বাইক চালাইনি। বাড়িতে দু দুটো মোটরসাইকেল ছিল, তবু আমি চালাতে পারি না। আমার স্কুল জীবন শেষ হয়ে, ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ হয়ে গেলো, তবু রয়েল এনফিল্ড বুলেট সেই একই জায়গায় দাড়িয়ে। স্কুল জীবনে সাইকেল চালিয়েছি, কিন্তু বাইক চালানোর সাহস বা সুযোগ কোন দিন আসেনি। রয়েল এনফিল্ড বুলেট আমাদের পরিবারে থেকেও যেন কেমন হারিয়ে গেলো। বহু বছর এর কোন ব্যাবহার নেই। বাবা মাঝে মধ্যে স্কুটার চালাতো। আমি কোন দিন উৎসাহ পাইনি বাইক চালানো শেখার বা কোন দিন মুখ ফুটে বলতে পারিনি যে আমি বাইক চালাবো। আজও আমি বাইক বা অন্য কোন গাড়ি চালাতে পারি না। সাইকেল চালাইনি প্রায় ৭ বছর।
আমি তখন হ্যদেরাবাদে এম.টেক করছি, হঠাৎ একবার বাড়ি ফিরে দেখলাম রয়েল এনফিল্ড বুলেট নেই, যেখানে রাখা ছিল বহু বছর। শুনলাম মাত্র ১০০০০ টাকায় সেটা বিক্রি হয়েছে। স্কুটারটা এখন রাখা আছে গ্রামের বাড়িতে, গোয়াল ঘরে। বাবা বহু বছর হল বাইক বা স্কুটার কিছুই চালায় না। আমার মনে, আমার শৈশবের স্মৃতি এততাই বর্তমানের মত উজ্জ্বল, যে এখন যেকোনো রয়েল এনফিল্ড বুলেট দেখলে আমি বলে দিতে পারি, সেই ৮০ এর মডেল আর আজকের মডেলের মধ্যে কি কি পার্থক্য।
শেষ বার বাবার গাড়িতে চড়েছি চার চাকায়। আমার ছোট ভাই নিজের ব্যাবহারের জন্য একাটি চারচাকা কিনেছিল। ২০১৮ তেই, এই কয়েক মাস আগে বাড়ির কয়েকজনের সাথে এক আত্মীয়ের বাড়ি ঘুরে এলাম, বাবাই ড্রাইভ করলেন। কিন্তু রয়েল এনফিল্ড বুলেটে পিছনের সিটে আর বসা হল না বাবার সাথে।
সঞ্জয় হুমানিয়া
১২ জুলাই ২০১৮, বেঙ্গালুরু, ইন্ডিয়া
★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★