বাবার পেছনে বসতাম আমি—ছোট্ট আমি। দু’হাত দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতাম রয়্যাল এনফিল্ড বুলেটের পেছনের সিটে। কালো রঙের, ৩৫০ সিসির সেই বাইকটা ছিল আমাদের গ্রামের একমাত্র মোটরসাইকেল। সময়টা ছিল ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪–৯৫। বাবা তখন কর্মসূত্রে ঘুরে বেড়াতেন নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, হাওড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনার আনাচে কানাচে। ট্র্যাক্টরের ব্যবসা ছিল আমাদের, সেই সূত্রেই এই চষে বেড়ানো। তখন আশেপাশের গ্রামগুলোতে ট্র্যাক্টর খুব কমই ছিল, আর সেই ব্যবসাটাই ধীরে ধীরে আমাদের সংসারটাকে দাঁড় করাতে শুরু করে।

রয়্যাল এনফিল্ড বুলেটের প্রতি আমার এক অদ্ভুত টান তৈরি হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে, নিজেকে যখন চিনতে শিখেছি, তখন থেকেই দেখেছি সেই বাইকটাকে। একদম ছোটবেলায় চোখ বড় বড় করে প্রতিটা যন্ত্রাংশ দেখতাম—কিক স্টার্ট, গিয়ার বক্স, ব্রেক, হেডলাইট, ট্যাংকির গায়ে লেখা “Royal Enfield”… যেন ওটাই ছিল আমার প্রথম খেলনা। আজও, এই মধ্যবয়সে এসেও সবকিছু কেমন টাটকা মনে হয়।

বাবা-মায়ের সঙ্গে আত্মীয়দের বাড়ি যাওয়া, বাজারে কেনাকাটা করা, পুজো-পার্বণ ঘুরে দেখা—সব কিছুর নীরব সঙ্গী ছিল সেই বুলেট। কতবার যে মামার বাড়ি গেছি সেই বাইকে চড়ে, তার কোনো হিসেব নেই। দাদু-দিদিমারা আগেই বুঝে যেতেন—আমরা আসছি। কারণ, গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে আসার সময় সেই বাইকের গম্ভীর ভটভট শব্দ অনেক দূর থেকেই কানে ভেসে আসত।

একটা ঘটনা এখনো চোখে ভাসে। রাতের বেলা, আমরা সবাই খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়েছি। হঠাৎ ঠাকুমা মা-কে ডাকলেন—”মা, ওঠ! খোকা বাড়ি আসছে।” তখন বাবা যশোর রোড থেকে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় নামতেন, আর সেই আওয়াজ—ভট! ভট! ভট!—সরাসরি বাড়ির দরজা অবধি এসে পৌঁছাত। দিনের বেলা সে আওয়াজ হারিয়ে যেত গ্রামের কোলাহলে, কিন্তু রাতে? স্পষ্ট শোনা যেত।

আরও কত গল্প জমে আছে মনে! একবার বাইকে কিছু সমস্যা হয়েছিল। গ্যারেজে দেওয়া হয়েছিল সারানোর জন্য। আমি তখন ছোট, বাবার সঙ্গে গ্যারেজে গিয়েছি। গিয়ে দেখি বাইকটা একদম খুলে ফেলা—লণ্ডভণ্ড অবস্থায় পড়ে আছে। বুক ধকধক করছিল। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি বাইকটা আর আগের মতো হবে না। যেন আমার প্রিয় খেলনা ভেঙে ফেলেছে কেউ!

তারপর কেটে গেল অনেক বছর। বাবাও ধীরে ধীরে বাইক ছেড়ে স্কুটারে অভ্যস্ত হলেন—একটা বাজাজ স্কুটার ছিল আমাদের। আর সেই বুলেট? পড়ে থাকল বারাসাতের বাড়িতে। এক কোণে, নীরবে। আমি কোনোদিন চালাইনি ওটা। সাহস পাইনি, সুযোগও আসেনি। স্কুলে সাইকেল চালাতাম, কিন্তু বাইক চালানো শেখা হয়নি। ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে ফেললাম, জীবনের গতি বেড়ে গেল, কিন্তু বুলেটটা দাঁড়িয়ে রইল ঠিক আগের জায়গায়।

তারপর হঠাৎ একদিন হায়দরাবাদ থেকে বাড়ি ফিরে শুনলাম—বুলেট আর নেই। মাত্র দশ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে! বুকটা কেমন খালি হয়ে গেল। যেখানে বাইকটা দাঁড়িয়ে থাকত, এখন সেখানে শুধু শূন্যতা। স্কুটারটা এখনো আছে—গ্রামের বাড়ির গোয়ালঘরে ধুলোমাখা হয়ে পড়ে থাকে। বাবা এখন আর কিছুই চালান না।

তবু আজও রাস্তায় যদি কোনো পুরনো রয়্যাল এনফিল্ড দেখি, আমি ঠিক চিনে ফেলি—“এই সেই মডেল! এই আওয়াজটা চেনা!” আমার শৈশব এখনো সেই আওয়াজে বাজে। আজও আমি বাইক চালাতে পারি না, এমনকি সাইকেলও চালাইনি গত সাত বছর।

শেষবার বাবার গাড়িতে উঠেছি ২০১৮-তে। ছোট ভাই একটা চারচাকা কিনেছিল নিজের ব্যবহারের জন্য, সেই গাড়িতে করে এক আত্মীয়র বাড়ি ঘুরে এসেছিলাম। বাবাই চালিয়েছিলেন। কিন্তু রয়্যাল এনফিল্ড বুলেটের পেছনের সিটে বাবার সঙ্গে আর কখনও বসা হয়নি।

আর হবেও না।

সঞ্জয় হুমানিয়া
১২ জুলাই ২০১৮, বেঙ্গালুরু, ইন্ডিয়া

★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *