ঢেঙ্গা চেহারা, শুকনো মুখ, ঢোকা চোয়াল, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, লম্বা নাক আর চোখ দুটো গর্তের মধ্যে ঢোকা। দেখেকেই বোঝা যায় পরিশ্রমী মানুষ, হ্যা সত্যি পরিশ্রম করতেন দেশপান্ডে জি। আমি শুধু তার পদবীটাই জানতাম, আসল নাম জিজ্ঞেস করার কোনদিন প্রয়োজন হয়নি। আমি তাকে ‘দেশপান্ডে জি’ বলেই ডাকতাম। দেশপান্ডে জির সাথে পরিচয় হয় ২০১২ সালের শেষের দিকে, তখন আমি মহারাষ্ট্র রাজ্যের ঔরঙ্গবাদ শহরে। সদ্য চাকরি পেয়েছিলাম, এক সরকারি আপিসে। অনেক বড়ো বড়ো সরকারি আপিসে, সরকারি কর্মচারীরা নিজেদের মধ্যে দল বেঁধে এক অতি চমৎকার নিয়মে আমাদের মতো গাধাদের চাকরি দেয়।
ধরুন, আপনি মস্ত এক সরকারি সংগঠনের সরকারি কর্মচারী। বেশ কয়েক বছর চাকরি করে আপনি ক্লান্ত, মোটা বেতন আপনার। আপনি তখন কি করবেন, নিজের সহকর্মীদের সাথে যুক্তি করে একটা সদ্য কলেজ শেষ করা যুবক কে একটা অস্থায়ী কাজ দিলেন, যার পোশাকি নাম contractual job. এই যুবক আপনার নীচে অস্থায়ী ভাবে আপনার সব কাজ করে যাবে, আর আপনি বাবুর মতো পায়ের উপরে পা তুলে বসে দিন কাটাবেন। আপনি আপনার মোট বেতনের ২০% এই যুবক কে বেতন হিসাবে দেবেন। যুবকটি ১০০০০ বা ১২০০০ টাকায় খুশি। এবার এই যুবকের চরিত্রে আমাকে বসিয়ে নিতে পারেন।
যাই হোক, এবার মূল গল্প শুরু করি। দেশপান্ডে জি আমার দুবেলার খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। মারাঠি মানুষরা বাইরের দোকানের বা হোটেলের খাবার রোজ রোজ খেতে পছন্দ করে না। আমরা বাঙালি যেমন আপিসে টিফিন বাক্স করে দুপুরের খাবার নিয়ে যেতো লজ্জা পাই, ওরা তেমন পায় না। আমরা যেমন আপিসের বাইরে চায়ের দোকানে বা রাস্তার সস্থা হোটেলে লাঞ্চ করতে বেশি পছন্দ করি, মারাঠিরা তেমন করে না। ওরা বাড়ির খাবার টিফিন বাক্স করে আপিসে নিয়ে গিয়ে খেতেই বেশি পছন্দ করে। আর সেই টিফিন বাক্স, হয় নিজে বা ডাব্বাওয়ালা বয়ে নিয়ে যায় আপিসে। মহারাষ্ট্র রাজ্যে এই ডাব্বাওয়ালা একটা জীবিকা।
ডাব্বাওয়ালা (আগে বলা হতো টিফিনওয়ালা) একজন ভারতীয়, বিশেষত মুম্বাইয়ে, যে কর্মচারীদের বাসা থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে তাদের অফিসে পৌছে দেয়। সকালের শেষদিকে ডাব্বাওয়ালারা বাসাবাড়িতে গিয়ে লাঞ্চবক্সে (ডাব্বা) ভরে দেয়া গরম গরম খাবার নিয়ে যায়, সাইকেল বা রেলওয়ের ট্রেনে চেপে তা লোকদের কর্মস্থলে পৌঁছে দেয় এবং বিকালে আবার খালি লাঞ্চবক্স ফিরিয়ে দিয়ে যায়।
মুম্বাইয়ের খাদ্য সরবরাহকারীরাও ডাব্বাওয়ালাদের কাজে লাগায়; তখন তারা কেন্দ্রীয় রান্নাঘর থেকে তৈরি/রান্নাকরা খাবার বয়ে নিয়ে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেয়। মুম্বাইয়ে অধিকাংশ অফিস কর্মচারীরা বাইরের বা হোটেলের খাবারের চেয়ে ঘরে-তৈরি খাবার খেতে বেশি পছন্দ করে, সাধারণত স্বাদ ও পরিচ্ছন্নতার জন্যে, যেকারণে এই শ্যবস্থার উৎপত্তি। অনেক মহিলারা ডাব্বাওয়ালাদের মাধ্যমে এরকম ঘরে-তৈরি খাবার সরবরাহ করে উপার্জন করেন।
আলাদা আলাদা মানুষের বাড়ি থেকে ডাব্বা অর্থাৎ টিফিন বাক্স নিয়ে পৌঁছে দেয় নির্দিষ্ট আপিসে বা ইস্কুলে। দেশপান্ডে জির জীবিকা ছিল এই ডাব্বাওয়ালার কাজ। আমাদের মতো যারা একা থাকে এবং রান্না করে না, তাদের জন্য থাকে অন্য বেবস্থা। দেশপান্ডে জি নিজের বাড়িতে রান্না করে সেই ঘরোয়া খাবার ডাব্বায় ভোরে দুবেলা দিয়ে যাবে। এর বিনিময়ে মাসের প্রথমেই এক মাসের অগ্রীম টাকা দিতে হবে, আর সঙ্গে দিতে হবে একটি ডাব্বা। দেশপাণ্ডে জি প্রায় তিন বছর আমাকে দুবেলা রেঁধে খাইয়েছে সময় মতো।
সেবার পূজোর বোনাস পেয়েছি ৫০০০ টাকা। এক দুপুরে আপিসের গেটে দেশপান্ডে জি গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে আমার জন্য। কাছে গিয়ে জানতে পারলাম ওনার স্কুটি খারাপ হয়ে গিয়েছে, ইঞ্জিন ঠিক করতে হবে, এবং যদি সম্ভব হয় আমাকে কিছু টাকা ধার দিতে হবে ওনাকে। এমনি ওনার করুন মুখ, তার উপরে সেদিন ওনার চোখ ছলছল করছিল। আমার মনে দয়ার সঞ্চার হলো, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে কর্ণ মনে হয়েছিল। আমি ওনাকে টাকাটা রাতের খাবার দেওয়ার সময় দেবো বললাম। সে রাতের খাবারের পরিমান ও গুণগত মান অন্য দিনের থেকে অনেক ভালো ছিলো। বোনাসের পুরো ৫০০০ টাকা তাকে ধার হিসাবে দিয়ে দিলাম। টাকা দেওয়ার পরে মনের ভিতরে এক অদ্ভুদ ভালো লাগা। কাউকে উপকার করার যে ভালো লাগার অনুভূতি, তা লিখে বোঝানো যাবে না। মনে মনে নিজেকে দাতা কর্ণ আর রাজা হরিষচন্দ্রর মত কিছু একটা ভেবে ফেললাম সেই রাতে। পান্ডে জি কে আমি আরো বলেছিলাম, তার নিজের সুবিধা মতো ফেরৎ দিতে, কোনো তাড়াহুড়ো নেই।
এক মাস পরে দেশপান্ডে জি আমাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আমার মাসিক ডাব্বার টাকা থেকে ওই টাকা কাটিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। আমি তখন সে প্রস্তাব না মেনে, বলেছিলাম – ” মাসের ডাব্বার টাকা আপনাকে আমি প্রতি মাসে দিয়ে দেব। আর ওই ৫০০০ টাকা আপনার কাছে থাক, আমার যখন প্রয়োজন হবে আমি চেয়ে নেবো”। দেশপাণ্ডে জি এ প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছিলেন, এবং আমাকে বলেছিলেন যে, শুধু এক মাস আগে তাকে জানাতে যে টাকা কবে লাগবে।
২০১৬ তে আমি চাকরি ছাড়ার মনস্থির করেছিলাম। চাকরি ছাড়ার বিজ্ঞপ্তি সময়কাল (notice period) এক মাসের, সুতরাং ইস্তফাপত্র যেদিন জমা দিয়েছিয়াম সেদিই দেশপাণ্ডেকেও বলেছিলাম। এক মাস দেখতে দেখতে কেটে গেলো, অবশেষে আমার বিদয়ের দিন চলে এলো। আপিস থেকে বিদয় নিয়ে ৪-৫ দিন আমি অউরঙ্গবাদে ছিলাম। সহকর্মী আর বন্ধুদের সাথে শেষ দেখা করে নিলাম। কিন্তু দেশপাণ্ডে জি কথা রাখেনি। কোন এক অজানা কারনের জন্য উনি টাকা দিতে পারলেন না, আর আমিও জোর করলাম না। উনি নিজেই আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর চেয়ে নিয়েছিলেন, এবং পরের সপ্তাহে দিয়ে দেবে বলেছিলেন।
আমি তখন নতুন চাকরির খোঁজে বেঙ্গালুরুতে। প্রায় এক বছর হয়ে গিয়েছিলো, তবু দেশপাণ্ডে জি কথা রাখেনি। আমার তখন টাকার প্রয়োজন, মাঝে মাঝেই ফোন করি, টাকা চাই। আজ দেবো কাল দেবো করে রোজ বলে, সঙ্গে না না সমস্যার গল্প। শেষমেশ আমি হাল ছেড়ে টাকা চাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। মাস তিনেক পরে এক রাতে নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন ঘাঁটছি, হঠাৎ দেশপাণ্ডে জির নম্বর চোখে পড়লো। ফোন করলাম ওনাকে, কিন্তু উনি ফোন ধরলেন না। আবার করলাম, এবার ফোন কেটে দিলেন।
সত্যি বলতে আমি টাকার জন্য ফোন করছিলাম না, ওনার সাথে একটা সুন্দর সম্পর্ক ছিল তাই খবর নেওয়ার জন্য ফোন করছিলাম। তৃতীয়বার ফোন করার পর ফোন ধরলো, কিন্তু অন্য কেউ। আমি দেশপাণ্ডে জির কথা জিজ্ঞাসা করতেই, উত্তর পেলাম যে এই রাত দুপুরে উনি বাড়ি নেই, কোথায় গিয়েছে, ফিরতে আরও রাত হবে। আমি বুঝতে পারলাম, দেশপাণ্ডে হয়তো লজ্জায় আমার সাথে কথা বলতে পারলো না। সেই রাতেই দেশপাণ্ডের নম্বর মুছে ফেলেছিলাম ফোন থেকে। হয়তো নম্বর থাকলে আবার কোন দিন ফোন করবো, আবার দেশপাণ্ডে লজ্জায় কথা বলবে না, সেই ভয়ে।
দেশপাণ্ডের মত মানুষ অসৎ হয় না। এই নিষ্ঠুর জীবন হয়তো অসৎ হতে বাধ্য করে। হয়তো এই নাম হীন সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে আমি যতটা কষ্ট পেয়েছি, দেশপাণ্ডে জি হয়তো তার থেকে আরও বেশী কষ্ট পেয়েছে। আমি ওই কটা টাকার জন্য কষ্ট পাইনি, কষ্ট পেয়েছিলাম ওই কটা টাকার জন্য একটা সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেলো, সেই জন্য। আর দেশপাণ্ডে হয়তো বেশী কষ্ট পেয়েছে উপায় না পেয়ে অসৎ হতে গিয়ে।
সঞ্জয় হুমানিয়া
২০ জুলাই ২০১৮, বেঙ্গালুরু, ইন্ডিয়া
★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★