আমার ছবি আঁকার মাস্টারমশাই বলেছিলেন যে, প্রায় সব মানুষের হাতের সাইজ (আয়তন) আর মাথার সাইজ (আয়তন) মোটামুটি এক হয়। কথাটা একটু সহজ করে ব্যাখ্যা করি, উদাহরণ হিসাবে আপনি নিজের উপর এটা প্রয়োগ করতে পারেন। আপনি আপনার যেকোনো একটি হাতের আঙ্গুল গুল সব সোজা করে হাতের তালু ঠিক নিজের মুখের উপরে রাখুন, সম্ভব হলে এটা আয়নার সামনে করুন। দেখবেন, আপনার মাথা আর মুখের সাইজ (আয়তন) মোটামুটি আপনার হাতের সাইজেরই। মানুষের স্কেচ আঁকার সময় এই পদ্ধতিতে মাথা, হাত আর শরীরের সাইজ (আয়তন) এর অনুপাত ঠিক রাখা হয়। আমার আঁকার মাস্টারের এই কথাটা আমার মনে দাগ কেটে ছিলো, দাগ কাটার পিছনে অবশ্যই একটা কারন ছিলো।
ছোট থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমার মাথার আয়তন একটু বড়। তখন অতটা বুঝতাম না, লোকে বলত আর আমি শুনতাম। অস্পষ্ট মনে আছে আমার, আমি তখন ও ইস্কুলে ভর্তি হয়নি, সেই সময় প্রথম আমাকে হেঁড়ে মাথা বলা হয়েছিলো। কে বা কারা বলেছিল ঠিক মনে নেই, তবে পরিচিত মানুষ বলেছিল, এই নিয়ে আবার হাসাহাসিও হয়েছিলো। এবার হয়ত আপনারা বলবেন, আমি মিথ্যা বলছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এমন অনেক ঘটনা আমার মনে আছে, যখন আমার বয়শ চার বা পাঁচ। কীভাবে মনে আছে আমি জানি না, এটাও জানি না অন্যদের মনে থাকে কি থাকে না। এই নিয়ে আমি একবার মায়ের সাথে কথা বলেছিলাম, আমার স্মৃতির সাথে মায়ের স্মৃতি মিলিয়ে নিয়েছিলাম। মা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, এত সব আমার কি করে মনে আছে।
আমি লেখক নই, আমি গল্প লিখতে পারি না। যা কিছু একটু-আধটু লিখি, সব আমার স্মৃতির উপরে নিরভর করে। যে সব ঘটনা এখন মনে আছে বা মাঝে মাঝে মনে পড়ে, আমি চেষ্টা করি লিখে ফেলার। বলা যায় না আর মনে থাকবে কি না, বা মনে পড়বে কি না।
সেই সময়, আমার গ্রামে মোটামুটি সবাই এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিল, যে আমার হেঁড়ে মাথা। আমার হেঁড়ে মাথা ভাবার পিছনে আর একটি কারন ছিলো। ছোট থেকেই আমার মাথার চুল খুবই ঘন আর মোটা ছিল। ছোট করে চুল কাটলেই, সব চুল খাঁড়া-খাঁড়া হয়ে থাকতো। এখানে “থাকতো” কথাটা এই জন্য ব্যাবহার করলাম, যে এখন আমার মাথার চুল কমেছে, সামনে আর মাথার উপরে যথেষ্ট পাতলা হয়ে এসেছে। তো সেই সময়, চুলের জন্য হোক বা মাথার আয়তনের জন্য আমাকে ওই হেঁড়ে মাথা উপাধি নিতে হয়েছিলো। ছোট বেলায় আমাদের বাড়িতে একজন বয়স্ক লোহা-ভাঙ্গা কেনার জন্য এক ফেরিওয়ালা আসতো। যতদূর মনে আছে, ওনার নাম ছিল “দাউদ”। তিনি এখনকার মত ফেরিওয়ালা ছিলেন না। উনি সাইকেলে বা গাড়িতে করে ফেরি করতেন না। ওনার কাঁধে থাকতো একটি বাঁশের বাঁক, আর বাঁকের দুই পাশে দড়ি দিয়ে ঝোলানো থাকতো বড় বড় দুটি বাঁশের তৈরি ঝুরি বা ঝাঁকা। এই ঝাঁকাতেই তিনি লোহা ভাঙ্গা, কড়া ভাঙ্গা, বালতী ভাঙ্গা, কাঁচ ভাঙ্গা কিনে বেড়াতেন। লোহা ভাঙ্গা, কড়া ভাঙ্গা, বালতী ভাঙ্গা, বা কাঁচ ভাঙ্গা পরিমাণে অল্প হলে তিনি আর ওজন করতেন না, আনুমানিক একটা দাম দিয়ে দিতেন কিম্বা বিস্কুট দিতেন। বাজারে এখনো সেই বস্কুট পাওয়া যায়, কাজু বাদামের মত দেখতে ছোট ছোট বিস্কুট। আমাদের বাড়ির সঙ্গে এই বয়স্ক ফেরিওয়ালার বেশ ভাব ছিল। যখনি আসতো, কিছু না কিছু অবশ্যই কিনে নিয়ে যেত। আমার ঠাকুমা, বাবা, মা এর সাথে কত সব গল্প করত ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে। এই ফেরিওয়ালা আমাকে “মোড়ল” বলে ডাকতেন, আমার এখন স্পষ্ট মনে আছে। তিনিও বলেছিলেন, “মোড়লের মাথাটা একটু বড়”।
আমার বয়সী বাচ্চাদের মাথার টুপি আমার মাথায় হোতো না। ছোটবেলা থেকেই আমি বছরে দুই বার নামাজ পড়ি, দুই ঈদের দিনে। আপনারা তো জানেন, নামাজ পড়তে গেলে মাথায় টুপি পরতে হয়, আমিও পরতাম। কিন্তু আমার মাথায় যে গোল বাচ্চাদের টুপি পরানো যেত না, আমার জন্য কেনা হয়েছিলো লম্বা টুপি। সোনালী সুতোর নক্সা করা, আকাশী রঙের একটা লম্বা টুপি। মারাঠিরা এক ধরনের সাদা লম্বা টুপি পরে, স্বাধীনতার আগে বা পরে এই টুপির বেশ দাপট ছিল। আমার টুপিও ঠিক ওই রাকম, সুধু আমাটা একটু রংচঙে ঝাঁকানাকা।
ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে আমার একবার মাথা ফেটেছিল। আপনারা ভাবছেন আমি খুবই দুরন্ত, কিন্তু আপনাদের অনুমান সম্পূর্ণ ভুল। আমি অল্প ভাষী, ঘর কুনো মানুষ। তবু আমার মাথা ফেটে ছিল, চরাটে সেলাইও দিতে হয়েছিলো। ছোট বেলায় মা আমাকে স্নান করিয়ে, মাথা আঁচরে দিয়ে দোনলা (হেলনা) তে বসিয়ে দিয়ে নিজে স্নানে করতে যেতেন। এই সময়টুকু আমি হয়তো ঠাকুমার চোখের সামনে বা একাই থাকতাম। মা স্নান করে ফিরে এসে আমাকে এক ফিডার দুধ দিতেন, আমি দোনলা (হেলনা) তে শুয়ে দোল খেতে খেতে খেতাম আর তার পর ঘুমিয়ে পড়তাম। এই ছিল আমার প্রতিদিনের বাধাধরা রুটিন। সেদিনও সব তেমনি চলছিল, মা স্নান থেকে ফিরে আমাকে এক ফিডার দুধ দিয়ে, দোনলা (হেলনা) তে দোল দিচ্ছে, হঠাৎ দড়ি ছিঁড়ে আমি ধপাশ, পাকা মেঝের উপরে। কানে এলো ঠাকুমার আর্তনাদ !! “আমার সঞ্জু ভাই পড়ে গেছে, আমার সঞ্জু ভাই পড়ে গেছে। ও মা, শিগগিরি কোলে তোল”। ঠাকুমার এক ভাই ছিলেন, নাম তার শাহাদাৎ। ঠাকুমা আমাকে বলতো, “সঞ্জু আমার শাহাদাৎ ভাই”। সঞ্জু নামে আমাকে ওই একজনই ডাকতেন আমার ছোট বেলায়।
আমি যন্ত্রণা অনুভব করলাম অনেক পরে। মা আমাকে কোলে নিয়ে মাথায় আঁচল চেপে দৌড়াচ্ছে যীতেন ডাক্তারের ডিসপেনসারিতে। মা এর পিছনে পিছনে ঠাকুমা আর্তনাদ করতে করতে ছুটছেন, “ওরে আমার সঞ্জুর মাথা ফেটে গিয়েছে”।
সময় ২০১৮ সাল, আমি বাইক চালাতে পারি না। আমি আর আমার roommate (ঘর সঙ্গী) সুমন, এক সঙ্গে থাকি এই প্রায় দেড় বছর। সুমনের একটি নীল রঙের ফেসিনো স্কুটি আছে। মাঝে মধ্যে দুজনে এক সঙ্গে বাইরে গেলে, ও স্কুটি চালায় আর আমি নাড়ুগোপালের মত পিছনে বসে থাকি। ব্যাঙ্গালোরে হেলমেট না পরলেই পুলিশ ফাইন করে। দুবার ফাইন দেওয়ার পরে আমি মনস্থির করলাম, বাইক নেই তো কি হয়েছে, একটা হেলমেট তো কিনতেই পারি, যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ১৭৫ টাকা দিয়ে কিনে ফেললাম একটা হেলমেট। এখন আমরা বাইরে গেলাই দুজনে দুটি হেলমেট। এদিকে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমার মাথাটা একটু বড়, একটা ঘটনা আবার মনে করিয়ে দিল যে আমার হেঁড়ে মাথা।
সুমন কে একদিন কোন কারনে আমার হেলমেটটা পরার প্রয়োজন হয়েছিলো। সেদিন রাতে ফিরে এসে সুমন বলল, “সঞ্জয় দা, তোমার হেলমেটটা খুব বড়, আজ বার বার মাথা থেকে খুলে হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস বেল্ট দিয়ে আটকানো ছিল”। আমি কিছু বললাম না, শুধু মুখ দিয়ে একটা ছোট্ট “হুউউ!” আওয়াজ করে ছিলাম। ওকে বুঝতেই দেইনি যে ব্যাপারটা আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার।
ব্যাঙ্গালোরে কমদামী হেলমেট ব্যাবহার বন্ধ করল পুলিশ, কিছু দিন আগে। আমার ১৭৫ টাকার ISI হীন হেলমেট ও বাদ পড়লো। গত ফেব্রুয়ারী মাসে সুমনের জন্মদিনে কেক কিনতে বেরিয়েছিলাম আদিত্য নামে এক পাশের ঘরের ছেলের সাথে। আদিত্যের বাইকে আমি সেই আগের মত নাড়ুগোপাল। এদিন আমি সুমনের হেলমেট পরে কেক আনতে গিয়েছিলাম। প্রথম দিকে ঠিক বুঝতে পারিনি, পরে অনুভব করলা। সুমনের হেলমেট আমার মাথায় আঁটসাঁট। জোর করে পরলে অবশ্যই পরা যায়, তবে বেশিক্ষণ পরে থাকলে মাথার দুই পাশে চাপ লাগে, আর সেই চাপ আমি আমার চোয়ালেও অনুভব করি।
তাহলে এটা সত্যি, “আমার মাথা মোটা”
সঞ্জয় হুমানিয়া
১৪ই মার্চ ২০১৮, বেঙ্গালুরু, ইন্ডিয়া
★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★

Bah…matha mota..
Hya, kichu oshotorko banan bhul ache.
Banan Amaro vul hoy. Amay loke bole vulo master. 👦
Thanks, dekhi banan thik korte hobe !!