ধর্মপুর, চলতি ভাষায় ধরমপুর। হাট, বাজার, দোকান, সেলুন, ডাক্তার, পোষ্ট অফিস, বাস স্ট্যান্ড আর পাকা রাস্তা—সবকিছুই পেতে গেলে আমাদের আসতে হয় ধরমপুরে। আসেপাশের তিন-চারটে গ্রামের একটাই বাজার। এখানেই সাপ্তাহিক হাট বসে, এখানে রেশনে কেরোসিন আর চিনি দেয়। এই হাটেই ছোটবেলায় বাবা বা কাকার সাথে হাট করতে যেতাম। আর পাঁচটা গ্রামের হাট যেমন হয়, ধর্মপুরের হাটও তেমন। তবে কবি গুরুর বক্সীগঞ্জের মত পদ্মা পাড় নেই, গরুর গাড়িতে বোঝাই করে কল্‌সি হাঁড়িও আনে না বংশীবদন। তবে জিনিসপত্র জুটিয়ে এনে গ্রামের মানুষ বেচে কেনে—উচ্ছে, বেগুন, পটল, মূলো, বেতের বোনা ধামা, কুলো।

এই ধর্মপুরেই হয় দুর্গাপূজা, আমার দেখা প্রথম পূজা। ছোট্ট একটা মেলা বসে এখানে, টিউব লাইট আর টুনি লাইট দিয়ে যশোর রোডের দুই ধার সাজানো হতো। মনোহরী দোকান, খাবারের দোকান, তেলে ভাজার দোকান আর বেলুনের দোকান। যশোর রোডের পাশেই ইটের তৈরি পাকা দুর্গা মন্দির। দুর্গাপূজার সময় সেজে ওঠে মন্দির আর তার চার পাশ। মন্দির আর যশোর রোডের মাঝে অনেকটা ফাঁকা জায়গা, দুর্গাপূজার মেলা এখানেই বসে। পাকা রাস্তার দুপাশেই মেলার দোকান বসে। রাস্তার দুই পাশের বড় বড় বুড়ো গাছগুলো পুরো মেলার উপর ছাতার মত দাঁড়িয়ে থাকে। যারা যশোর রোড ধরে বনগাঁ গিয়েছেন, তারা জানেন এই ব্যাপারটা। রাস্তার দুপাশেই দেখতে পাবেন বড় বড় প্রাচীন গাছের সারি।

এই মেলার বেলুনের দোকান আমার মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছিলো। এর পিছনে দুটি কারণ। প্রথমটি হলো, এই বেলুনের দোকানের মধ্যে একটি দোকান থাকতো আমাদের এক প্রতিবেশীর। পাড়াতুতো দাদা, বয়স আমার থেকে ১০-১২ বছরের বড়। ভালো নাম হাফিজুল, ডাক নাম হাপি, আমি ডাকি হাপি ভাই বলে। আর দ্বিতীয় কারণ হলো, এই বেলুনের দোকানগুলি কোনো সাধারণ দোকান না, ঘরের মতো দোকান না। দুই-তিন হাত দূরত্বে মোটা মোটা বাঁশ মাটিতে পোতা হতো লম্বা করে, তারপর আড়াআড়ি করে লম্বা বাঁশ বেঁধে দেওয়া হতো এই খাড়াই বাঁশের সাথে। অনেকটা বাঁশের বেড়ার মতো। তবে আড়াআড়ি বাঁশ থাকতো মাত্র দুটো বা তিনটে, আর এটা মাটি থেকে কোমর পর্যন্ত উঁচু থাকতো। সব থেকে উপরের বাঁশে ঝোলানো থাকতো জল বেলুন। আপনারা সকলেই জানেন সাধারণ বেলুন কী। কিন্তু জল বেলুন কী, অনেকেই জানেন না।

৯০-এর দশকে গ্রাম বাংলার বাচ্চাদের তেমন কিছু খেলনা থাকতো না, অন্তত আমাদের ছিল না। এই দুর্গাপূজা বা চড়কের মেলা থেকে কেনা বেলুন, চাবি দেওয়া জিপ গাড়ি, টিপ পটকা ফাটানোর কালো টিনের পিস্তল ছিল আমার বাৎসরিক খেলনা। ছোট ছোট লাল রঙের বেলুন, একটু মোটা রবারের তৈরি, তাতে জল ভরা থাকবে আর সঙ্গে লম্বা একটা রবারের দড়ি বাঁধা। এই রবারের দড়ি ডান হাতের মাঝের আঙুলে বেঁধে নিয়ে ভলি বলের মতো করে জলভর্তি বেলুনকে নাচাতে হতো। এই জল বেলুন খুব কম মানুষ বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারতো, খেলতে খেলতে প্রায়ই মেলাতেই ফেটে যেত, জল বেরিয়ে যেত।

মেলা চলতো পূজোর কয়দিন, আর প্রতিদিন কারো না কারো সাথে মেলায় যেতেই হবে আমার। কেনাকাটা বিশেষ কিছু হতো না, শুধু মেলার এ মাথা ও মাথা ঘোরা। মানুষ দেখতে, মানুষের ভিড় দেখতেই তখন খুব ভালো লাগতো। কারণ, আমাদের গ্রামের বসতি খুবই ফাঁকা ফাঁকা ছিল, অচেনা মানুষ প্রায় সারা বছর চোখে পড়তো না। দুই ঈদের সময় মসজিদে অনেক লোক দেখে আমার খুব ভালো লাগতো, আর এই দুর্গাপূজায়। আমার শৈশবে উৎসবের স্মৃতি বলতে দুই ঈদ, দুর্গাপূজা আর চড়কের মেলা।

হাপি ভাইয়ের দোকান থেকে জল বেলুন, নারণ কাকুর মনোহরী দোকান থেকে সবুজ রঙের চাবি দেওয়া জিপ গাড়ি আর কালো রঙের পিস্তল—এই ছিল প্রতি বছরের কেনাকাটা। জল বেলুনের আয়ু দু’ঘন্টা থেকে দু’দিন, জিপ গাড়ির আয়ু দু’তিন মাস আর টিনের কালো পিস্তল হয়তো পরের বছরেও চলতো। মেলার কোনো খাবার খাওয়া আমার আর দিদির বারণ ছিল, শুধু মাত্র বাদাম ভাজা ছাড়া। রসগোল্লা, সন্দেশ বা সিঙ্গাড়া যদি খেতে ইচ্ছা হয়, তবে ভোমের মিষ্টির দোকান থেকে। মল্লিক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ডাক নাম ভোমের দোকান বা ভোমের মিষ্টির দোকান। ভোম কাকুর ভালো নাম কী, আজও জানি না। ভোম কাকুর ছেলে মিঠুন আমার সহপাঠী ছিল। দু’বছর আমরা একই সাথে একই ক্লাসে পড়েছিলাম।

আমাদের গ্রামের বাড়ি পুরোনো আমলের একতলা ছাদের বাড়ি। পাশাপাশি দুটি শোয়ার ঘর, সেকালের ইটের পাকা বাড়ি, লাল রঙের মেঝে, সাদা চুনকাম করা দেওয়াল, মোটা মোটা কালো রঙের কাঠের দরজা জানালা, উঁচু ছাদ, উঁচু বারান্দা। সামনে খোলা উঠোন, উঠোন থেকে বারান্দায় উঠতে উঁচু উঁচু চারটে ধাপের সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রথমে বারান্দা, তারপর শোয়ার ঘর দুটি পাশাপাশি। এই বারান্দা ছিল আমার জিপ গাড়ি নিয়ে খেলার জায়গা। একবার এ মাথা থেকে চাবি ঘুরিয়ে ছেড়ে দেওয়া, আবার ওই মাথায় পৌঁছালে সেখান থেকে আবার চাবি ঘুরিয়ে এ মাথার উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেওয়া। মাঝে মাঝে রান্নাঘর থেকে ছোট ছোট কাঠের পিঁড়ি নিয়ে এসে ৩০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে মেঝেতে রাখতাম, জিপ গাড়ি আসা যাওয়ার রাস্তায়। এই খেলাটা শিখেছিলাম সার্কাস থেকে।

যারা ছোটবেলায় সার্কাস দেখেছেন, তারা হয়তো দেখেছেন, সেই সময় জিপ গাড়ির একটা খেলা দেখানো হতো। ছোটবেলায় ঠাকুমার সাথে বহুবার সার্কাস দেখেছি। তখন সার্কাসে হাতি, ঘোড়া, বাঘ, ভালুকের খেলাও দেখানো হতো। একটা সাদা রঙের জিপ গাড়ি, সঙ্গে কয়েকটা মোটর সাইকেলের একটা খেলা দেখানো হতো। কাঠের তৈরি একটা ইনক্লাইন র‍্যাম্প ব্যবহার করা হতো এই খেলায়। আনুমানিক ৩০ বা ৪০ ডিগ্রির একটা অ্যাঙ্গেলের ইনক্লাইন র‍্যাম্প। জিপ গাড়ি একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে একটা গতি নিয়ে এই র‍্যাম্পে উঠতো এবং ছোট্ট একটা ফ্লাই জাম্প করতো। আমার খেলনা জিপ নিয়েও সে খেলা খেলেছি। কিন্তু হায়!! আমার চাবি দেওয়া জিপ কোনোদিনই ফ্লাই জাম্প দেয়নি। খুব কষ্ট করে র‍্যাম্পে উঠে, ধপ করে পড়ে যেত ওপারে। কেন জাম্প করে না? এই চিন্তায় কত কী পরীক্ষা নিরীক্ষা করতাম। কখনো র‍্যাম্পের অ্যাঙ্গেল বাড়াতাম, কখনো কমাতাম। শেষমেশ বুঝতে পারতাম, যে জিপের গতি অর্থাৎ স্পিড বাড়াতে হবে। আর প্রত্যেক বছরই বেশি স্পিড পাওয়ার আশায় বেশি করে চাবি ঘোরাতাম খেলনা জিপ গাড়িতে। পরিণাম, কট করে স্প্রিং কেটে যেত।

এবার হয়তো ভাবছেন, যাহ!!! গাড়ি নিয়ে খেলা শেষ? আজ্ঞে না, খেলা এখনো শেষ হয়নি। এবার জিপের সামনে দড়ি বেঁধে খেলা শুরু। এবার আর শুধু বারান্দা নয়, এবার খেলার এরিয়া অনেক বড়ো। বড়ো উঠোন, জসমরুল তলা, পুকুর ধার ও বাড়ির চারপাশ—আমার জিপ দৌড়ে বেড়াতো, সঙ্গে মুখে থাকতো “ঘেঁ ঘেঁ” জিপের শব্দ।

এবার আসি কালো টিনের পিস্তলের গল্পে। আমার শৈশবের যে কালো পিস্তলের কথা আমি বলছি, সেটা হয়তো এখন আর পাওয়া যায় না। আজকাল যেটা পাওয়া যায়, সেটা প্লাস্টিক আর টিন দিয়ে তৈরি। ইন্টারনেটে অনেক খুঁজেও কোনো ছবি পেলাম না। একটা ছবি পেলাম, যেটা অনেকটা সেই আগেকার পিস্তলের মতো, তবে পুরোপুরি না।

এই পিস্তলের দুই ধরনের টোটা পাওয়া যেত। একটি টিপের মতো, অন্যটি লম্বা ফিতের মতো। দুটি টোটার ব্যবহারের পদ্ধতি আলাদা। ফিতে টোটাটি গোল করে পেঁচিয়ে বন্দুক খুলে ভেতরে ভরে দিতে হত। তারপর বন্দুক বন্ধ করে ঘোড়া টিপলেই ঠায়!! ঠায়!! ঠায়!!! আর টিপ টোটা ব্যবহার করতে বন্দুক খুলতে হত না। একটা একটা টিপ নিয়ে বন্দুকের হ্যামারের নিচে প্রথমে রেখে দিতে হতো আলতো করে। তারপর ঘোড়া টিপলেই ঠায়!! ব্যস, ওই একবার। আবার টোটা ভরো, তারপর আবার ঠায়! আমাকে প্রত্যেকবার এই টিপ টোটা কিনে দেওয়া হতো, কারণ ফিতে টোটা কিনে দিলেই সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ। ঠায় ঠায় ঠায় করে একসাথেই সব ফাটিয়ে ফেলতাম। টিপ টোটা ফাটাতে লাগতো সময় আর ধৈর্য, তাই চলতো অনেকদিন।

এই টোটা বিক্রি হতো বিভিন্ন কোম্পানির। আমাদের মেলায় পাওয়া যেত পাখি মার্কা আর সাপ মার্কা। কাকতালীয়ভাবে ফিতে টোটা পাখি ছাপ আর টিপ টোটা সাপ ছাপ কোম্পানির। এবার মজার ব্যাপার হলো, আমি ভাবতাম পাখি গাছে থাকে, তাই ফিতে টোটা দিয়ে মারতে হয়। কারণ ফিতে টোটা automatic, একবার ভরলেই অনেকবার ঠায় ঠায় ঠায়। আর বন্দুকও যেমন খুশি ঘোরানো যায়, টোটা পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। এদিকে টিপ টোটা ফাটাতে গেলে বন্দুকের নল সবসময় মাটির দিকে করে রাখতে হয়। কারণ টিপ টোটা single টোটা, একটা একটা করে বন্দুকের হ্যামারের নিচে রাখতে হয়। প্রথমে বন্দুকের নল মাটির দিকে করতে হবে, তারপর বন্দুকের ঘোড়া টিপে হ্যামার উঁচু করতে হবে। তারপর টিপ টোটা আস্তে করে হ্যামারের নিচে রেখে খুব আস্তে আস্তে ঘোড়া ছেড়ে হ্যামার টোটার ওপরে আলতো করে রাখতে হবে। যখন final ফাটাতে হবে, তখনও বন্দুকের নল নিচের দিকে। কারণ একটু এদিক ওদিক হলেই, হ্যামার যখন উঠবে, ওমনি টোটা পড়ে যাবে। তাই সবসময় নল মাটির দিকে। আর সাপ তো মাটিতেই থাকে, তাই টিপ টোটায় সাপের ছবি।

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *