আমার দৈনন্দিন জীবন এমন সাদামাটা আর একঘেয়েমি সরল রেখায় চলতে থাকে যে গ্রাফের ওঠানামা একদম নেই বললেই চলে। বহু দিন পরপর ছোট ছোট মৃদু গ্রাফের ওঠানামা হয়, যখন একটা অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে যায়। নিস্তরঙ্গ জীবনে এই দুলুনি বেশ লাগে। বুকে বালিশ গুজে খাটের উপরে উপুড় হয়ে শুয়ে ল্যাপটপে মাথা গুজে আঙুলের টোকা পড়ে অভ্র কিবোর্ডে। আজ সেই দিন, লিখতে বসেছি একটি অতি সামান্য ও খুদ্র ঘটনা। পাঠকের কাছে হয়ত বোকাবোকা মনে হবে, তবে আমার কাছে বেশ উপভোগ্য।
গত কয়েক সপ্তাহ বেঙ্গালুরুতে কোভিড১৯ এর সংক্রামণ প্রতিদিন ১০০০ পার করে ফেলছিলো। সরকার বাহাদুর বললেন সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে সব বন্ধ করতে হবে। লেট-নাইট জীবন নাহি চলেগা!! যেমন আদেশ তেমন কাজ। দোকান বাজার ঘাটা সব ৮টার আগেই শুনশান। ঘরের সুবোধ ছেলে গোপাল ঘরে ফেরে ৮টার আগেই, আর দুএকটা রাখাল যারা আছে তারা ইচ্ছে করে রাস্তায় দেরি করে। সেই কবে ছোটবেলার বর্ণপরিচয়ের পাতা থেকেই রাখাল বদনাম। গোপাল বড় সুবোধ। তার বাপ মা যখন যা বলেন, সে তাই করে। যা পায় তাই খায়, যা পায় তাই পরে, ভাল খাব, ভাল পরিব বলিয়া উৎপাত করে না। গোপাল আপনার ছোট ভাই ভগিনী গুলিকে বড় ভাল বাসে। সে কখনও তাদের সহিত ঝগড়া করে না, তাদের গায় হাত তুলে না। এ কারণে, তার পিতা মাতা তাকে অতিশয় ভাল বাসেন। গোপাল যখন পড়িতে যায়, পথে খেলা করে না ; সকলের আগে পাঠশালায় যায় ; পাঠশালায় গিয়া, আপনার জায়গায় বসে ; আপনার জায়গায় বসিয়া, বই খুলিয়া পড়িতে থাকে ; যখন গুরু মহাশয় নূতন পড়া দেন, মন দিয়া শুনে। খেলিবার ছুটী হইলে, যখন সকল বালক খেলিতে থাকে, গোপালও খেলা করে। গোপাল যেমন সুবোধ, রাখাল তেমন নয়। সে বাপ মার কথা শুনে না ; যা খুসী তাই করে ; সারা দিন উৎপাত করে ; ছোট ভাই ভগিনী গুলির সহিত ঝগড়া ও মার:মারি করে। এ কারণে, তার পিতা মাতা তাকে দেখিতে পারেন না। রাখাল, পড়িতে যাইবার সময়, পথে খেলা করে ; মিছামিছি দেরি করিয়া, সকলের শেষে পাঠশালায় যায়।
যাইহোক, আমাদের পাড়ার মুদীর দোকান ঘড়ি মিলিয়ে ঠিক ৭টায় বন্ধ হচ্ছিলো বেশ কয়েকদিন। আমাদের সব্জি বাজার আর মুদীর কেনাকাটা থাকলে বিকালেই করে ফেলছিলাম। সেদিন বিকালেও তাই করলাম, কিন্তু সমস্যা হল রাত ৯টায়। রান্না করতে গিয়ে দেখলাম লবণ নেই। গরীবের সংসার, নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যায়। এবার কি হবে? ডাল আর আলু সিদ্ধ লবণ ছাড়া কিভাবে গলা দিয়ে নামবে? প্রতিবেশীর কাছে আর চাওয়ার মুখ নেই। গত কয়েকদিন ধরেই এটা ওটা চেয়ে আনছি। এর মধ্যে দুবার লবণ চাওয়া হয়ে গিয়েছে। অনেক ভেবে চিন্তে, ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলের মত সিদ্ধান্ত নিলাম যে আর লবণ চাইবো না প্রতিবেশীর কাছে। বেরিয়ে পড়লাম লবণ কিনতে। বাইরে বেরিয়ে মাথায় এলো, এখন তো সব দোকান বন্ধ। তবুও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। মন বলছে একটা না একটা রাখালের দোকান খোলা থাকবেই। বেশ কিছুখন এদিক ওদিক ঘুরে বুঝলাম আজকাল সবাই গোপাল হয়ে গিয়েছে।
অগত্যা ঘরের সামনে এসে ভাবছি কি করা যায়। পাড়ার জনপ্রিয় ছেলে সুনীল আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো, “কেয়া হুয়া সাঞ্জয় ভাই?” আমি আদ্যপ্রান্ত ঘটনা তাকে বললাম। সুনীল তো শুনেই হেসে বললো, “আইয়ে মেরে সাথ!”। আমি ওর সাথে চললাম মোড়ের মুদীর দোকান ঘরের দিকে। বন্ধ দোকান ঘরের পাশে গিয়ে সুনীল একটা বস্তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে এক প্যাকেট টাটার লবন বার করে নিয়ে এলো। আমি অবাক!!! এ কি? বস্তা ভর্তি লবণ দোকানের বাইরে? এটা তো আমি আগেও দেখেছি, কিন্তু এই বস্তার মধ্যে যে লবণ থাকে তা জানতাম না। আমার কাছে কেমন অদ্ভুত লাগলো। সুনীল কে বললাম কাজটা কি ঠিক হলো? সুনীল বলল কাল সকালে দাম দিয়ে দিলেই হলো। আর দোকানদার কিছু বললে আমি যেন তাকে ফোন করে জানাই।
রান্না করতে করতে অনেক ৭-৫ ভাবলাম। আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও কি লবনের বস্তা বাইরে থাকে? কি জানি!!!
সঞ্জয় হুমানিয়া
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, বেঙ্গালুরু, কর্ণাটক, ইন্ডিয়া
★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★