আমি তখন উচ্চমাধ্যমিকের দোরগোড়ায়। এই সময় প্রায় সব ছাত্র-ছাত্রীরই পাখা গজায়। কথায় আছে,
“পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে “
ঠিক সেই অবস্থা তখন আমার। সময়টা ২০০৪ সাল। আমাদের বাড়িতে তখনও সাদাকালো কাঠের টেলি-ভীষণ (TV)। অনেক জোরাজুরি করে সেই সময় একটা সিডি প্লেয়ার কিনেছিলাম। আমাদের বাড়িতে ক্যাবল কানেকশন ছিল না, তাই বিনোদনের একমাত্র ভরসা ছিল ডিডি ১, ডিডি ২ আর ডিডি ৭। আজকের প্রজন্ম হয়তো এই তিনটি চ্যানেলের গুরুত্ব বুঝবে না, তাই একটু ব্যাখ্যা দরকার।
ডিস বা ক্যাবল টিভি আসার আগের যুগে, দূরদর্শনের এই সরকারি চ্যানেলগুলোই বিনামূল্যে সম্প্রচারিত হতো। ডিডি ১ এবং ডিডি ২ ছিল মূলত হিন্দি অনুষ্ঠানের জন্য, আর ডিডি ৭ বাংলা অনুষ্ঠান সম্প্রচারের জন্য।
আমাদের টিভির অ্যান্টেনার তখন প্রায় শেষ অবস্থা। ভাঙা অ্যান্টেনার কাঠামো পড়ে ছিল ছাদে, কিন্তু তার বা টিভির সঙ্গে কোনো সংযোগ ছিল না। ফলে, সিডি প্লেয়ারই একমাত্র ভরসা। নতুন সিনেমার সিডি ভাড়া আনতাম ১৫-২০ টাকায়, পুরনো সিনেমা ৫ টাকায়। তবে, চেনা দোকানদার না হলে সিডি ভাড়া নিতে জমা রাখতে হতো ১০০-১৫০ টাকা।
রঙ্গিন মুঘল-ই-আজম সেই বছর মুক্তি পেল। চারদিকে এই নিয়ে হৈচৈ। আমাদের পাড়ার চায়ের দোকানে তখন বুদ্ধিজীবীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই সিনেমা। একদিন নাড়ুদার সিডি দোকানে গিয়ে দেখি, রঙ্গিন মুঘল-ই-আজম এর সিডি চলে এসেছে! সামনে সিডির খাপে ঝুলছে পোস্টার। সিনেমার কথা শুনেই উত্তেজনায় কাঁপছিলাম। সিডি ভাড়া ১৫ টাকা, কিন্তু নাড়ুদা-কে পটিয়ে ৫ টাকায় নিয়ে নিলাম।
নাড়ুদা বারবার সতর্ক করে বলে দিল,
“বিকালেই সিডি দিয়ে যাবি, নতুন সিনেমা”
সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিতে দিতেই ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে ছুটলাম বাড়ির দিকে। কিন্তু সেদিন রাস্তা যেন শেষই হচ্ছিল না। মনের মধ্যে তখন শুধু একটা গান বাজছে,
“প্যায়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া…”
বাড়ি পৌঁছেই দরজা ধাক্কা মেরে খুলে এক দৌড়ে টিভির সামনে। তাড়াহুড়ো করে টিভি আর সিডি প্লেয়ার চালু করলাম। তবে সিডি প্লেয়ার যেন আমার উত্তেজনা বাড়ানোর জন্যই ধীরে ধীরে কাজ করছিল। অবশেষে, প্রথম সিডি প্লেয়ারে ঢোকালাম। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো Loading…।
কিন্তু মুঘল-ই-আজম এর প্রিন্ট দেখে আমি রাগে ফেটে পড়লাম। সাদা-কালো, ঝাপসা প্রিন্ট! রাগ সামলে দ্বিতীয় সিডি লাগালাম। একই অবস্থা! মাথা গরম করতে করতে সিডি ফেরত দিতে বের হতে যাব, তখনই মাথায় বাজ পড়লো।
“আমাদের টিভি তো সাদা-কালো! মুঘল-ই-আজম রঙিন হোক বা সাদা-কালো, আমাদের টিভিতে তো সবই সাদা-কালো হবে!”
সাইকেল নিয়ে ফের সিডি ফেরত দিতে বের হলাম। নিজেকে তখন খুব মূর্খ মনে হচ্ছিল। নাড়ুদা যেন টের না পায়, তাই রাস্তা দিয়ে একটু ঘুরে এক ঘণ্টা পরে সিডি জমা দিলাম।
নাড়ুদা জিজ্ঞেস করল,
“কি রে? কেমন লাগলো মুঘল-ই-আজম ?”
আমি উত্তর দিলাম,
“ভালো, তবে হল প্রিন্ট তো, তাই একটু ঝাপসা!”
আজ এত বছর পরে এই হাস্যকর অভিজ্ঞতার কথা মনে হলে নিজের মূর্খামিতেই হাসি পায়। তখনকার সেই ছেলেমানুষি এখন এক মিষ্টি স্মৃতি।