পাড়া-গাঁ ছাড়া আর দেখা যায় না, অন্তত আমি দেখিনি। আমি হাত পাখার কথা বলছি। হাত পাখা বলতেই আমাদের মনে আসে তালপাতার হাত পাখার কথা। ছোটবেলা থেকে এই হাত পাখার সাথে আমার পরিচয়। গ্রামে তখন কারেন্ট অর্থাৎ বিদ্যুৎ আসেনি, রাতে হ্যারিকেন আর ল্যাম্পই ছিল ভরসা। হ্যারিকেন নিয়ে একটা স্মৃতি আমি আগে লিখেছিলাম, আজ আর সেই কথায় যাব না। আজ আমি আমার হাত পাখার স্মৃতি নিয়ে একটু ঘষামাজা করব।

আমার এখনো মনে আছে, বাবা যখনই তালপাতার পাখা কিনে বাড়িতে আনত, আমি প্রথমেই সেটা শুকে ঘ্রাণ নিতাম। শুকনো তালপাতার একটা অদ্ভুত সুগন্ধ আছে। নতুন বইয়ে যেমন একটা সুন্দর গন্ধ থাকে, ঠিক তেমনি নতুন তালপাতার পাখায়ও একটা সুন্দর গন্ধ থাকে। গ্রীষ্মকালে যেমন খটখটে মাটির উপরে প্রথম বৃষ্টি পড়লে একটা সুন্দর গন্ধ পাওয়া যায়, নতুন বই আর তালপাতার পাখার গন্ধও তেমন মন ভরিয়ে দেয়।

আমি যতদূর দেখেছি, হাত পাখা তিন প্রকারের হয়। প্রথমত তালপাতা আর তার নিজস্ব হ্যান্ডেল বা ডাঁট দিয়ে বানানো হাত পাখা। পাখার তালপাতা আর পাখার হ্যান্ডেল বা ডাঁট একটিমাত্র তালপাতা দিয়ে তৈরি। গোল করে কাটা তালপাতা, গোল আকৃতি পাতার দু-ধারে সরু করে বাঁশের কাঠি দু-পাশ দিয়ে সুতো দিয়ে গোল করে বাঁধা থাকত। বাঁশের কাঠির দুই পাশেই থাকত তালপাতার ত্রিকোণ আকৃতির নকশা। বাঁশের কাঠি সুদৃশ্য করার জন্য সবুজ বা নীল রঙ লাগানো থাকত। গোল আকৃতির তালপাতা আর ডাঁট বা হ্যান্ডেল যেখান থেকে শুরু ঠিক সেখানে লাল রঙ করা থাকত। হ্যান্ডেল লম্বা প্রায় হাত মুঠো করে এক হাত। কিছু কিছু তালপাতায় আবার হলুদ রঙ আবছা করে লাগানো থাকত।

দ্বিতীয় ধরনের পাখা হল, তালের পাতা সম্পূর্ণ আলাদা করে গোল করে কেটে, তাতে আলাদা ভাবে বাঁশের হ্যান্ডেল বা ডাঁট লাগানো থাকত। এখানেও গোল করে কাটা তালের পাখায় গোল বরাবর বাঁশের কাঠি দিয়ে সেই একই ভাবে সেলাই করা থাকত। বাঁশের হ্যান্ডেল মাথার দিকে একটু চিরে তার ভেতরে তালের পাতা আটকে দেওয়া হত, আর ছোট ছোট পেরেক বাঁশের হ্যান্ডেলে লাগিয়ে দেওয়া হত।

এই দুই ধরনের সাধারণ তালের হাত পাখা আমাদের বাড়িতে দেখা যেত। এই দুই প্রকারের মধ্যে, সব থেকে টেকসই হতো প্রথম ধরনের পাখাটি। দ্বিতীয় ধরনের পাখাটির হ্যান্ডেল কিছুদিন যেতে না যেতেই ঢিলা হয়ে যেত। যেখানে পেরেক মারা থাকত, ঠিক সেখান থেকেই তালপাতা কাটা শুরু করত।

এই দুই ধরনের হাত পাখা ছাড়াও আর এক ধরনের পাখা ছিল আমাদের বাড়ি। বাড়িতে নতুন কোনো অতিথি এলে বা অনেক অতিথি এলে এই তৃতীয় ধরনের হাত পাখার আবির্ভাব হতো। আমার ঠাকুমার একটা সবুজ রঙের টিনের ট্রাঙ্ক ছিল। যখনই ঠাকুমা এই টিনের ট্রাঙ্ক খুলতেন, তখনই ন্যাফথলিনের গন্ধে সারা ঘর ভরে উঠত। ঠাকুমার সাদা শাড়ির আঁচলে সব সময় এক গোছা চাবি বাঁধা থাকত। যখনই আমাদের বাড়িতে হাত পাখার টানাটানি পড়ত, তখনই ঠাকুমা সেই চাবির গোছা থেকে একটা চাবি ঘুরিয়ে সবুজ টিনের ট্রাঙ্কের তালা খুলতেন। আমি মাঝে মাঝেই এই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী থাকতাম। ঠাকুমার সবুজ রঙের টিনের ট্রাঙ্কে থাকত সাদা রঙের শাড়ি, সাদা রঙের মিহি সেলাইয়ের সৌখিন কাঁথা, লাভা কোম্পানির সাদা দাঁতের মাজনের কৌটায় কিছু অলংকার, আর এই বিশেষ ধরনের পাখা।

গোল একটি লোহার মোটা তারের রিং, আর এটিকেই ফ্রেম হিসাবে ব্যবহার করে রঙিন ও সাদা-কালো সুতো দিয়ে বোনা একটা কাপড়ের মত ডিজাইন। কাজটি খুবই নিখুঁত এবং কঠিন। সুই-সুতো ব্যবহার করে এক ধরনের পাখা তৈরি করা হত। এতে হাতের নানা কারুকাজ ভরপুর থাকত, থাকত সুতোর নকশাও। সাধারণত লাল, হলুদ, বেগুনি, সবুজ, নীল, সাদা সহ নানা রঙের সুতো ব্যবহার করে আস্তে আস্তে তৈরি করা হত এই পাখা। পাখা বোনা শেষ হলে বাঁশের ডাঁট বা হ্যান্ডেল লাগিয়ে পাখাকে ব্যবহারের উপযোগী করা হত। ডাঁট বা হ্যান্ডেলের উপরে মাঝে মাঝে আরও একটা ফাঁপা বাঁশের নল আকৃতির হ্যান্ডেল লাগানো থাকত, যাতে পাখাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া খাওয়া যায়।

ঠাকুমা আজ নেই, সেই পাখাও আর নেই। কথায় হারিয়ে গিয়েছে সেই পাখা। এখন গ্রামে বিদ্যুৎ চালিত পাখা আর বৈদ্যুতিক আলো। এখনো মাঝে মাঝে কারেন্ট না থাকলে পাখার ডাক পড়ে, তালের পাখা হাজিরও হয়ে যায়। কিন্তু ঠাকুমার সেই সুই-সুতো ব্যবহার করে তৈরি করা পাখা আর দেখতে পাই না। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, কারেন্টের এই পাখা আর আলোর উপরে অভিমান করে কথায় যেন নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছে সেই পাখা।

সুতোর তৈরি হাত পাখা
সুতোর তৈরি হাত পাখা
Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *