ছুটিতে মামার বাড়ি গিয়েছি। মামার বাড়ি এক পাল ছেলেপিলে, সন্ধ্যে হলেই লুকোচুরি খেলা, দিনের বেলা এ বাগান ও বাগান বমবম করে ঘুরে বেড়ানো, মাছের ঘেরি / ভেড়ি তে সালতি (ছোট নৌকা) চরা। নিজেকে ধম্মের ষাঁড় মনে হতো মাঝে মাঝে, দড়ি থেকে ছাড়া পেলে যেমন গরুর পালের অবস্থা হয়, আমাদের সেই অবস্থা। মাসতুতো আর মামাতো ভায়েরা মিলে সে এক লাগাম ছাড়া দিন কাটানো। সাপ্তাহিক হাটের দিন ভুটভুটি (দমকল চালিত নৌকা) করে হাটে যাওয়া, পুকুরে মাছ ধরা, সব্জি খেত থেকে সব্জি তোলা, কত কাজ আমাদের। বেশ কাটছিল দিনগুলো।
ধর্মপুর থেকে 78E বাসে করে বারাসাত নামতে হতো, তার পর বারাসাত থেকে ২৩ নম্বর বাসে করে টাকি রোড ধরে গোলাবাড়ি হয়ে ডান দিকে বোয়ালঘাটা রোড। আমাদের নামতে হতো সর্দারহাটি বা বোয়ালঘাটা। হেটে বা ভ্যানে করে যেতে হলে সর্দারহাটি নামতে হতো, আর যদি সাপ্তাহিক হাট বার হতো, তবে বোয়ালঘাটা নেমে ওখান থেকে ভুটভুটি (দমকল চালিত নৌকা) করে তেহাটা গ্রাম আমার মামার বাড়ি। আমার দাদুর কোন ছেলে ছিল না, সুতরাং নিজের মামা নেই। তাই বলে মামা বাড়ির সুখ থেকে আমার বঞ্ছিত হইনি। আমার দাদুর বড় ভাইএর অনেক ছেলে, সুতরাং আমাদের মামার অভাব নেই। ওকে না কাকাতো মামা, তাতে কি? নেই মামার থেকে কাকাতো মামা ভালো।
এদিকে সামনে হোলি / দোল যাত্রা, যদিও আমাদের ধর্মে এই রঙিন উৎসবের পালনের কোন নিয়ম নেই। ধর্মে নেই তো কি হয়েছে, রঙ খেলতে ক্ষতি কি। আর মামাবাড়ির কোন এক প্রতিবেশীর বিয়ের অনুষ্ঠান পড়লো দোল এর আগের দিন। আমাদের ধর্মে বিয়ের দিন পঞ্জিকা দেখে ঠিক হয় না, কোন একটা দিন হলেই হল। ছোট গ্রাম, তাই গোটা গ্রামেই বেশ একটা বিয়ে ভাব নিয়ে চলা ফেরা চলছে। পাড়া জুড়ে নতুন মুখ, সবাই বিয়ে বাড়ির আত্মীয়। আমরাও লেগে পড়লাম, তাদের সাথে।
কিছু বাংলার গ্রামে আমি দেখেছি বিয়ের আগের দিন বিয়েবাড়ির লোকে রঙ খেলা করে, যদি আবীর বা রঙ পাওয়া যায় খুবই ভালো আর যদি না পাওয়া যায় তবে কাদামাটি দিয়েই সেই রঙ খেলার নিয়ম পালন হয়। আমাদের কপাল ভালো ছিল, কয়েকদিন পরেই দোল, দোকানে আবীর আর রঙ পাওয়া যাচ্ছিলো। সেদিন সকালে বিয়েবাড়ি থেকে অল্প কিছু রঙ পেলাম খেলার জন্য, আমার সবাই অল্প অল্প রঙ হাটে নিয়ে ঘরাঘুরি শুরু করলাম।
এবারে আমি একটু অন্য প্রসঙ্গে ঢুকবো। একটু নীলের ইতিহাস নিয়ে কিছু তথ্য আপনাদের জানাবো। বাংলা ভূখন্ডে ইন্ডিগোফেরা এর ১৫ প্রজাতির গাছ জন্মে। তার মধ্যে indigofera tinctoria নীল রং এর চাষ করা হতো ভারতে। নীল পানিতে দ্রব্য গুকোসাইড নামক রাসায়নিক হিসাবে থাকে। এই উপমহাদেশের মাটি নীল চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় বৃটিশ নীল করেরা বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করে নীলচাষে। নদীয়া, যশোর, বগুড়া, রংপুর প্রভৃতি জেলায় নীলচাষ ব্যাপক ভাবে করা হতো। উনিশ শতকের শেষের দিকে নীলচাষ অর্থনৈতিক ভাবে লাভজনক না হওয়ায় কৃষকরা ধান ও পাট চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বৃটিশ নীলকরেরা অত্যাচার আর নিপীড়নের মাধম্যে নীলচাষে বাধ্য করলে ১৮৫৯-৬০ সালে নীলচাষীরা এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলে। এর পরে বাংলায় নীল চাষ ক্রমে বিলুপ্ত হয়।
বাংলায় নীল চাষ বিলুপ্ত হলেও কিছু মানুষের এই নীল ব্যাবহারের সভাব বিলুপ্ত হয়নি। আমার ঠাকুমা আর দিদিমা কে দেখেছি এই স্বভাবের বশীভূত হয়ে সাদা শাড়িতে এই নীল ব্যাবহার করতে। আমি ৯০ এর কথা বলছি, তখন আমি অনেক ছোট। আমার ঠাকুমা আর দিদিমা যে নীলের ঢ্যালা ব্যাবহার করত সেটা আসল গাছ থেকে পাওয়া নীল কি জানি না। কিন্তু সেই সময়ে বাজারে এই নীলের ঢ্যালা কিনতে পাওয়া যেত। তখন বাজারে রমরমা কারবার ‘রবিল ব্লু’ নামক একদরনের নীলের গুড়ো। কিন্ত আমার ঠাকুমা আর দিদিমা সেই পুরনো দিনের নীলের ঢ্যালা ছাড়া আর অন্য কিছু ব্যাবহার করবে না।
ফিরে এলাম মামা বাড়িতের বিয়ের আগের দিনের ঘটনায়। রঙ খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে, চেনা মুখ বা অচেনা মুখ, কাউকে বাদ দিচ্ছি না। সবাই কে রঙ মাখাচ্ছি প্রান ভরে। অনন্যারা আমাকে মাখাক বা না মাখাক আমি নিজেই আগে নিজের মুখে রঙ মেখে নিয়েছি আয়না দেখে, অল্প রঙ, হয়তো অন্য কে মাখাতে মাখাতে আমাকে কেউ মাখালো না, তাই প্রথমে নিজে নিজে।
রঙ খেলার মাঝামাঝি আমি খেয়াল করলাম আমার রঙ শেষ, অন্য সবার কাছে রঙ আছে এবং সবাই হৈহৈ করে খেলছে। দৌড়ে গেলাম পাড়ার দোকানে, দোকান বন্ধ।, দোকানওয়ালা নিজেও রঙ খলছে রাস্তায়। এবার কি হবে? আমি কি রঙ খেলার সম্পূর্ণ সুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকবো? আমার চোখের কোনে এক বিন্দু জল। অন্যের কাছে রঙ চাওয়া বেকার, কেউ দেবে না। মাথায় তখন বজ্রপাত, কি হবে এখন? বজ্রপাতের আলোর ঝলকানি তে আমি একটা রাস্তা দেখতে পেলাম। আমি দিদিমার খাটের গদির কোন এক কোনে, পয়সা খুজতে গিয়ে আবিস্কার করেছিলাম নীলের ঢ্যালা, কাগজে মুড়ে রাখা আছে। আমার চোখ চকচক করে উঠলো, ঠোটের কোনে দুষ্টুমি হাসি। লোকচক্ষু এড়িয়ে পৌঁছে গেলাম, প্রথমে মাথার দিকে তার পর পায়ের দিকে। নীলের ঢ্যালা প্রাপ্তি হল পায়ের দিকে। চুপচাপ পকেটে সবটুকুই।
চাপা কলে গিয়ে বেশ ভালো করে হাতে জল আর একটা নীলের ঢ্যালা মাখাতে লাগলাম। আমার হাত তখন ধবধবে নীল, চোখে মুখে দুষ্টুমির হাসি। শুরু হল আবার রঙ খেলা, কিন্তু এক মাত্র আমিই খেয়াল করলাম আমার নীল রঙ আর অন্যদের নীল রঙ অনেক আলাদা।
কেউ বুঝতেই পারলো না যে আমি নীলের ঢ্যালা দিয়ে রঙ খেললাম।
রঙ খেলা শেষ, কেউ পুকুরে আর কেউ চাপা কলে স্নান করছে। সবাই সব রঙ ধুয়ে ফেলার কাজে বাস্থ। এদিকে আমার হাটের গাড়ো নীল রঙ উঠলো না, আমার হাত নীল, ঠিক যেমন বাচ্চাদের ছবিতে রামায়ন বইএর রামের গায়ের রঙ। বুঝলাম এ নীল এক দিনে উঠবে না, অন্য সব রঙ আবছা হয়েছে, কিন্তু এই নীল রঙ জ্বলজ্বল করছে। মনে মনে একটা গানের লাইন গেয়ে ফেললাম, “ইয়ে নীল রঙ, কাব মুঝে ছোড়ে গা?”।
বিকালে বিয়ে বাড়িতে গায়ে হলুদ, তারপর সন্ধ্যায় পাত্রিকে সবাই মিষ্টি মুখ করিয়ে তার হাতে কিছু টাকা গুজে দেওয়ার অনুষ্ঠান। মিষ্টি বলতে কেউ রসগোল্লা ভাববেন না, এখানে মিষ্টি হল আলোচালের (সেদ্ধ না করা চাল) এর ক্ষীর বা পায়েস বলতে পারেন। সন্ধ্যায় হ্যাঁচাক জলে উঠলো গ্রামে, চারিদিকে সাদা আলো। রোজ আমাদের সন্ধ্যা হলদে-টে, আজ ধবধবে সাদা। সাদা জামা কাপড় অনেক দিন ধোয়ার পর নীল না দিলে যেমন হলদে ভাব চলে আসতো, আমাদের রোজকার সন্ধ্যে তেমন ছিল। আজ নীল দেওয়া সাদা জামার কাপড়ের মত ধবধবে সাদা সন্ধ্যা।
আজ সন্ধ্যায় চারপাশ চকচক করছে, দিনের মত মনে হচ্ছিল। সকলের চোখে মুখে আবছা রঙ খেলার ছাপ। কিন্তু, আমার হাত আর কিছু মুখে গারো নীল রঙের ছাপ। এমনি একজন কে সামনাসামনি দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভুতের ভয় নয়, ভয় অন্য দিকে। আমার দুই হাত যে রঙে রাঙানো, সেই একই রঙ কয়েকজনের গালে ও চোখে মুখে। আমি আস্তে আস্তে আমার দুই হাত পকেটে ধুকিয়ে ফেললাম। কেউ কিছু জানতে পারলো না।