ভূমিকা

তিরুপতি(Tirupati) হায়দ্রাবাদ থেকে ৫২৫ কিলোমিটার আর বেঙ্গালুরু থেকে ২৬৫ কিলোমিটার দূরে তিরুপতির অবস্থান অন্ধ্রপ্রদেশের দক্ষিণপ্রান্তে। পূর্বঘাট পর্বতমালার সাতপাহাড়ের পাদদেশে তিরুপতি শহর। প্রচলিত লোককথা, এই সাতপাহাড় বিষ্ণুর শয্যা শেষনাগের সাতটি ফণা। মন্দিরশহর তিরুমালার অবস্থান একটি পাহাড়ের চূড়োয়। সোনার পাতে মোড়া এই মন্দিরটিই বিশ্বের সবচেয়ে বিত্তশালী মন্দির।

তিরু শব্দের অর্থ লক্ষ্মী। লক্ষ্মীর পতি অর্থাৎ ভেঙ্কটেশ্বর স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু। একশো কিলোগ্রাম সোনায় মোড়া গর্ভগৃহে পদ্মের উপর দাঁড়িয়ে আছে চতুর্ভুজ দেবতা, নানা আবরণ ও রত্নখচিত মুকুট পরা। দেবতার চোখদুটি ঢাকা। মন্দিরে আছে দেবতার দুই স্ত্রী-শ্রীদেবী ও ভূদেবী। প্রচলিত লোককথা, দেবতা ভেঙ্কটেশ্বর বিয়ের সময় কুবেরের কাছে অর্থ ধার করেছিলেন এবং ভক্তেরা আজও সেই ধার শোধ করছেন।

লোকের মুখে অনেক গল্প শুনেছিলাম, যে অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুপতি এক বিশাল সংখ্যক ব্যবসায়ীর ‘বিজনেস পার্টনার’ হলেন স্বয়ং তিরুপতি মন্দিরের উপাস্য ভগবান শ্রী ভেঙ্কটেশ্বর স্বামী !! ধরা যাক আপনি ব্যবসায়ী, একটা শাড়ির দোকান খুললেন। দোকানের ব্যবসার ৩০% অংশিদারী স্বত্ব তিরুপতি বালাজীকে উত্সর্গ করলেন আর ভগবানকে মনে মনে ডেকে বললেন, “হে প্রভু, তুমি আজ থেকে আমার ব্যবসার অংশীদার, তুমি আমার ব্যবসাকে দেখো। এমন কি ইন্টারনেটেও কোথায় যেন পড়েছিলাম এই ব্যাপারটা। নিজে একবার দেখার ইচ্ছা ছিল এই মন্দিরটি।

যাত্রা শুরু

২য় অগাস্ট ২০১৮, দুপুর বেলা খাওয়াদাওয়ার পর আমার এক বন্ধুর সাথা আড্ডা মারতে মারতে এই মন্দিরের কথা উঠে আসে। সে নাকি ৮, ১০ বার গিয়েছে এই মন্দিরে। আমি বললাম, “আমি তো একবারও যেতে পারলাম না”। তড়াক করে বন্ধু বিছানায় উঠে বসে বলে উঠলো, “চলো, তবে আজেই যাই”। যেমন প্রস্তাব, তেমনই আমি রাজি হয়ে গেলাম। কথা হল, সে তার ঘরে গিয়ে রেডি হয়ে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছাবে বিকাল ৬টায় এবং আমিও যেন রেডি হয়ে ৬টায় পৌঁছে যাই। এই বলে বন্ধু বেরিয়ে গেল নিজের ঘরের উদ্দেশে। তখন সবে বেলা ৩টে, আমার হাতে অনেক সময়।

বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখি বন্ধু আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত। দুজনের পরনেই হাঁফ প্যান্ট, টি-শার্ট আর পিঠে একটি ব্যাগ। এখান থেকে আমারা লোকাল বাসে চেপে ম্যাজিস্টিক বাস টার্মিনাল, এখান থেকেই পাওয়া যাবে তিরুপাতি যাওয়ার বাস। বেঙ্গালুরুর ইন্দিরা ক্যান্টিন থেকে আমার রাতের খাওয়া সেরে ফেললাম মাত্র ১০+১০ টাকায়। সব থেকে নিম্ন বাস ভাড়া ২২৩ টাকা, সাধারণ Andhra Pradesh State Road Transport Corporation (APSRTC) এর বাস, সাধারণ সিট (2+3), বাসের নাম SAPTAGIRI EXPRESS. তবে আমরা এই বাসে গেলাম না। আমি বাঙালি মধ্যবিত্ত, তাই মধ্যস্থ ধরণের বাস পছন্দ করলাম। বাসের নাম SUPER LUXURY(Non-AC, 2 + 2 Push Back, ভাড়া মাত্র ৩৫০ x ২ = ৭০০ টাকা (দুজনের)।

রাত ৮টায় ব্যাঙ্গালোর থেকে বাস ছাড়ে আর ভোর ৩টেয় তিরুপতি বাস স্ট্যান্ড পৌঁছে যায়। এখান থেকে আমার শেয়ারিং অটোরিক্সা করে পোঁছালাম Alipiri Gate, Dwaraka Nagar, Tirupati. এখানে Free Luggage Centre এ নিজেদের ব্যাগ জমা দিয়ে দিলাম, কারন ব্যাগ নিয়ে আমার পায়ে হেটে পাহাড়ে উঠবো না। এই ব্যাগ আমরা পেয়ে যাবো পাহাড়ের উপরে TTD Footpath luggage center এ। এই দুই এর মাঝে পথ হল ৮ কিলোমিটার, যে পথ আমার পায়ে হেটে ৩৫৫০টি ধাপ ভেঙ্গে পাহাড়ে উঠবো। যদি আপনি পায়ে হেটে পাহাড়ের উপরে মন্দিরে উঠতে না চান, তবে আপনি তিরুপতি বাস স্ট্যান্ড থেকে লোকাল বাস নিতে পারেন পাহাড়ের উপরে ওঠার জন্য। এই বাস ভাড়া মাত্র ৫৫ টাকা, বাচ্চার ভাড়া ৩০ টাকা মাত্র।

শুরু করলাম পাহার চড়া। প্রথম ১৫০ সিঁড়ি উঠতেই আমার হৃৎপিণ্ড আর আমার বুকের ভিতরে থাকতে চাইছিল না। সে যেন অস্বাভাবিক ভাবে লাফাতে লাফাতে আমার বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়। হৃৎপিণ্ড কে দেখাদেখি ফুসফুসও হাঁপাচ্ছে। আমার কাছে এই ৩৫৫০টি ধাপ চড়া অসম্ভব মনে হচ্ছিলো। আমি প্রায় হাল ছেড়ে বসে পরেছিলাম সিঁড়ির ধারে। গলগল করে ঘাম ঝরছে আর হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস তাল মিলিয়ে DJ mix সঙ্গিতের মত নাচানাচি করছে। তখন ভোর ৩:৩০। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার সিঁড়ি ওঠা শুরু। সঙ্গে নেওয়া ১ লিটার জল প্রথম ৫০০ ধাপেই শেষ। এই পথে পানিয় জলের অভাব নেই, মাঝে মাঝেই আছে পরিস্কার শৌচাগার। দেখলাম অনেকেই হামাগুড়ি দিয়ে এই ৩৫৫০ ধাপ সিঁড়ি ওঠার সঙ্কল্প নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে, এদেরকে দেখে আমি মনোবল পেয়েছি। এরা যদি হামাগুড়ি দিয়ে ৩৫৫০ ধাপ পাহার চড়তে পারে, তবে পায়ে হেটে আমিও পারবো। ১০০০ ধাপ ওঠার পরে ব্যাপারটা একটু স্বাভাবিক হল। শরীর মেনে নিয়েছে এই পদযাত্রা।

২৬৮০ ধাপে আমরা একটু বেশী বিশ্রাম নিলাম। এখানে একটি বিশাল হনূমান মূর্তি আছে। অনেকেই এখানে বিশ্রাম নিচ্ছে, কেউ কেউ এখানে একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছে। আমার কয়কটি ছবি তুলে আবার যাত্রা শুরু করলাম। এদিকে আস্তে আস্তে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে, আমরা এগিয়েই চলেছি ধির স্থির ভাবে। ধাপেধাপে উঠতে উঠতে দিনের আলোয় খেয়াল করলাম যে এই সিঁড়ির ধারে অসংখ্য ছোট ছোট পাথর একটার উপরে একটা সাজানো আছে। দেখে বেশ অদ্ভুত মনে হল। কৌতূহলে আমি বন্ধু কে জিজ্ঞাসা করলাম, কি এই সব? বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর। পাথর গুলি এমন অদ্ভুত ভাবে সাজিয়ে রাখে আমাদের মতই যারা পায়ে হাটা দর্শনার্থী। অনেকে মানত করে এই পাথর সাজিয়ে, যদি মনোস্কামনা পূর্ণ হয় তবে আবার এসে এই পাথর নামিয়ে রেখে যাবে। শেষমেশ আমার পৌঁছে গেলাম ৩৫৫০টি ধাপ উপরে, একেবারে মন্দিরের কাছে।

প্রথমেই আমাদের ব্যাগ সংগ্রহ করে নিলাম। বিনামূল্যে নিচে থেকে ব্যাগ উপরে নিয়ে আসে মন্দির কর্তৃপক্ষ, শুধু উপরে এসে ব্যাগ নেওয়ার সময় ১০ টাকা ঘুষ দিতে হয় স্বেচ্ছাসেবক কে। এখানে ঘুষ না দিলে আপনি আপনার ব্যাগ খুজেই পাবেন না। ব্যাগ বুঝে নিয়ে আমারা চললাম “মাধবা নিলায়াম” এর দিকে। এটি একটি বিনামূল্যে থাকা ও খাওয়ার জায়গা। মন্দির কর্তৃপক্ষ এখানে দর্শনার্থীদের জন্য সুন্দর বেবস্থা করে রেখেছে। এখানে বিশ্রাম ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার জন্য আলাদা আলাদা হল রয়েছে এবং প্রাতঃরাশের ব্যবস্থাও আছে। আমার স্নান খাওয়া করে মন্দির দর্শনের জন্য বেরিয়ে পড়লাম। সাধারণত এখানে প্রায় ৫-৬ঘন্টা কিম্বা তার বেশী লেগে যায় মন্দির দর্শনের জন্য। কিন্তু আমাদের লাগলো মাত্র ৪ ঘণ্টা। মন্দিরে পাবেন বিভিন্ন ধরণের দর্শনের লাইন, আমরা ফ্রী এর লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। যেমন টাকা তেমন লাইন, বেশী টাকা অল্প সময় আর আল্প টাকা বেশী সময়। এবার হয়ত আপনি ভাবছেন আমরা কি ভাবে মাত্র ৪ ঘণ্টায় দর্শন করলাম? Thanks to বনগাঁ-শিয়ালদা লোকাল। বনগাঁ-শিয়ালদা লাইনে ট্রেনে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা আমার রক্তে রয়েছে। আপিস টাইমে শিয়ালদা মুখি ট্রেনে আর সন্ধায় বনগাঁ মুখি ট্রেনে যদি আপনার আসাযাওয়া থাকে, তবে আপনিও আমার মত ৪ বা ৫ ঘণ্টায় এই মন্দিরে দর্শন পেতে পারবেন ফ্রীর লাইনেও।

লম্বা তারের খাঁচার লাইন, কখনো ফাঁকা পেলেই আপনাকে দৌড়াতে হবে আবার ভিড় হলে আপনাকে ঠিক ভিড় বনগাঁ লোকালে ওঠার মত কৌশল অবলম্বন করতে হবে। সন্ধ্যায় যারা বিধাননগর বা দমদম থেকে বনগাঁ লোকালে ওঠেন তারা বুঝবেন এই কৌশল। ভিড় ট্রেনে যদি একবার ওঠা জায়, ব্যাস !! আপনাকে আর কিছুই করতে হবে না। আপনাকে ঠিক এগিয়ে নিয়ে যাবে সহ যাত্রী। আবার নামার সময় শুধু একটু বলবেন যে আমি বারাসাত বা হাবড়া নামবো, আপনাকে নিজে কিছু করতে হবে না। জনগন জনস্বার্থেই আপনাকে নামিয়ে দেবে। এই মন্দিরের দর্শনের লাইনেও ঠিক তাই, শুধু আপনাকে ভিড় বনগাঁ লোকালের ওঠার কৌশলটি অবিরাম চালিয়ে যেতে হবে। “ভিড়ে প্রান যায় যাক, ঢুকে যাবো করে ফাঁক”।

মাত্র ২ সেকেন্ডের দর্শন। আপনি যে লাইনেই হন না কেন দর্শন মাত্র ২ সেকেন্ড। মন্দিরের স্বেচ্ছাসেবকরা আপনাকে ঠিক পাশ করিয়ে দেব, ঠিক যেন আমি কনভেয়ার বেল্টের উপরে দারিয়ে আছি। দর্শনের পরে লাড্ডু নেওয়ার পালা। একটি লাড্ডু ফ্রি, মাথা পিছু আপনি ৪ টি লাড্ডু আরো কিনতে পারেন মাত্র ৭০ টাকায় অথবা ৪ টের কম নিলে প্রতি লাড্ডু ২০ টাকা। তার পরেও যদি আপনার এক্সট্রা লাড্ডু প্রয়োজন হয় আপনি এক্সট্রা লাড্ডুর লাইনে দাঁড়াতে পারেন। এক্সট্রা লাড্ডু ১০০ টাকায় ৩টা বা ৪টে।

মন্দির থেকে বেরিয়ে যখন রাস্তায় উঠলাম, মনে একটা তৃপ্তি। শেষমেশ তিরুপতি মন্দির দেখা হল। এদিকে শরীর কিন্তু সঙ্গ দিচ্ছে না, আমার হাঁটু কাঁপছে, পায়ের পাতা ব্যেথা, চোখ জ্বালা করছে ঘুমের জন্য। এখান থেকে “মাধবা নিলায়াম” অল্প রাস্তা, তবুও হেটে যেতে মন চায় না। ঘোড়া দেখলেই খোঁড়া! আমি ও মন্দিরের ফ্রি বাস দেখে আর হাটতে পারলাম না। এই টুকু পথ ফ্রি বাসে চরলাম। এবার একটু বিশ্রাম। “মাধবা নিলায়াম” এ পৌঁছে আমরা প্রথমে হাতমুখ ধুয়ে গরম খিচুড়ি আর ঠাণ্ডা কার্ড রাইস খেয়ে ফেললাম তৃপ্তি করে। একটু বিশ্রাম নিয়ে স্নান করে আবার বেরিয়ে পড়লাম আশেপাশে একটু ঘুরে দেখতে। সন্ধার তিরুপতি মন্দির আলোয় আলকিত, চারপাশে বয়ে চলেছে জনস্রোত। মন্দিরের বাইরে জনসাধারণের জন্য সন্ধ্যা আরতি দেওয়ার যায়গা আছে। আমরা ঠিক এরই পাশে সিঁড়িতে বসলাম, অনেকেই বসে আছে। এখন আর শরীরে বা মনে আর ক্লান্তি নেই, আমি পুরো ফিট। মন্দিরের ভিতরে ছবি তোলা নিশিদ্ধ সাধারণ মানুষের জন্য, আমিও সাধারণ মানুষ তাই ছবি নেই। মন্দিরের বাইরেই ছবি তুললাম দুই বন্ধু মিলে, লোক কে তো দেখাতে হবে যে আমরা এসেছিলাম।

এবার ফেরার পালা, তবে এবার আর পায়ে হেটে না। তিরুমালা থেকে বাসে করে তিরুপতি, ভাড়া মাত্র ৫৫ টাকা। “মাধবা নিলায়াম” থেকে আমাদের ব্যাগ নিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগলাম। বাসে উঠে গা এলিয়ে দিতেই একটা ঝিমুনি এলো, এদিকে বাস পাহাড় থেকে ঢালুতে সাই সাই করে নামছে সাপের মত হেলে দুলে। বাসের সাথে সাথে আমিও ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে দুলছি। ৪০ মিনিত সময় লাগলো নিচে নামতে। তিরুপতি থেকে আবার বাসে করে বেঙ্গালুরু, ভাড়া মাত্র ৩৫৫ টাকা। এই বাসে একটু ঘুমালাম, কিন্তু ঠাণ্ডার জন্য একটু কষ্ট পেয়েছি। বেঙ্গালুরু পৌঁছলাম ভোর বেলা। নিজের ঘরের বিছানায় যখন শরীর এলিয়ে দিলাম তাখন সকাল ৫টা। শেষে একটা কথা বলতে চাই, তিরুমালার ভেঙ্কটেশ্বর মন্ধির যথেষ্ট পরিষ্কার পরিছন্ন এবং সকল শ্রেণীর মানুষের খেয়াল রাখা হয়। আমার শ্রেণী অনুযায়ী আমি সুন্দর ভাবে এই মন্দিরের দর্শন করেছি। মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ হয়ে তো আমি আর উচ্চবিত্তদের সাথে টক্কর দিতে পারবো না!

সঞ্জয় হুমানিয়া
০৭ অগাস্ট ২০১৮, বেঙ্গালুরু, ইন্ডিয়া

★আমার লেখায় প্রচুর বানান ভুল থেকে যায়। অনুরোধ করবো একটু মানিয়ে গুছিয়ে নিতে। সম্ভব হয়ে বানান ভুল ধরিয়ে দেবেন কমেন্ট করে★

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *