Share this post:

ঈদ উপলক্ষ্যে প্রতিটি মানুষ যারা কর্মীসূত্রে বাড়ির বাইরে থাকে, সকলেই ঘরে ফেরার চেষ্টা করে। দেশের বাইরে থাকুক বা দেশের মধ্যে, সকলেই ফিরে আসে নিজের আপনজনের কাছে। আজ এই ঘরে ফেরা নিয়েই একটি অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেবো সকলের সঙ্গে। গত কাল আমি ঘরে ফিরলাম, আর আজ সকালেই লিখতে বসে গেলাম। স্মৃতি একটু পুরোনো হয়ে গেলে খুঁটিনাটি ঘটনা মানুষ ভুলে যায়, টাটকা ঘটনার টাটকা অভিজ্ঞতা লিখতে বসলে খুঁটিনাটি সব কিছু লিখে রাখা যায়।

আমার বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা থানার অন্তর্গত চড়ুইগাছি গ্রামে। কর্ম সূত্রে আপাতত বেঙ্গালোরে। ২ মাস আগে ট্রেনের স্লিপার ক্লাসের (sleeper class) টিকিট কেটেছিলাম, শেষে ট্রেনের chart তৈরি হলো, আমাদের RAC ১৩০,১৩১,১৩২ আর এটাই আমার অপরাধ। যাই হোক, একটা GK এর বই কিনে পড়তে পড়তে ট্রেনে উঠালাম। এখন তো আবার ট্রেনে একদল মানুষ GK এর প্রশ্ন করে, না বলতে পারলে চড় থাপ্পড় মারধর। আমি মোটামুটি কয়েকটি ধর্মীয় স্লোগান আর আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নাম মুখস্থ করে নিলাম। যদি আমার ফ্লাইটের বা AC টিকিট কাটার সামর্থ থাকতো, তবে হয়তো এই অপরাধের জন্য কষ্ট পেতে হতো না। মধ্যবিত্ত মানুষ, এটাই অপরাধ। সরকারের কাছে আমরা অপরাধী, সমাজের কাছে আমরা অপরাধী, রাজনীতির কাছে আমরা অপরাধী, আর এই অপরাধের শাস্তি আমারা নানা ভাবে নানা দিক থেকে পেয়ে থাকি। উচ্চবিত্ত বা রাঘববোয়াল হলে হয়তো এত কষ্ট পেতাম না।

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্য জেলার বহু হতভাগ্য মানুষ যারা পেটের টানে বাইরে পড়ে থাকেন, বা বলা ভালো, থাকতে বাধ্য হন দুটো পয়সার জন্য, তারা কাতারে কাতারে বাড়ি ফেরেন কোন এক উৎসব কে উপলক্ষ করে। এই মানুষজনের লাইফলাইন মূলত আজিমগঞ্জ-হাওড়া এবং লালগোলা-শিয়ালদা লাইন। বিভিন্য রাজ্য থেকে তারা প্রথমে হাওড়া ও শিয়ালদহ আসেন, তার পর ছড়িয়ে পড়েন বিভিন্য পথে। এই রেলপথে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা আছে এরকম ব্যক্তি মাত্রই জানেন, কি নিদারুন পরিস্থিতির মাধ্যমে মালদা মুর্শিদাবাদ এর এই সমস্ত হতভাগ্য মানুষরা গরু ছাগলের থেকেও খারাপ অবস্থায় ট্রেনে ভ্রমণ করতে বাধ্য হয়!

এখানে “ভ্রমণ” শব্দটি ব্যবহার করতেও দুবার আমাকে ভাবতে হলো। ভ্ৰমন শব্দটি শুনলেই মনে হয়, কোনো এক journey যেটা খুব সুখের। প্রশাসন তথা সরকার তো অনেক কিছু উপলক্ষ্যেই বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করে থাকেন, (এমনকি IPL এর মত জুয়ার জন্য ও), তাহলে এদের জন্য কেন করা যায় না? নাকি এদের সরকার ভারতীয় নাগরিক বলে মনেই করে না? প্রসঙ্গত উল্লেখ যোগ্য, কিছু রেল কর্মী কিন্তু এই সহজ সরল মানুষ গুলোর দুরাবস্থার ভরপুর সু্যোগ নিয়ে ফায়দা তুলছেন। দেখছি শুধু মাত্র একটু বসার জায়গা করে দিতে ৫০০/ ১০০০/ এমন কি ১৫০০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছেন, আর এরাও কিছুটা বাধ্য হয়ে, কিছুটা ঘরে ফেরার আবেগে দিয়ে দিচ্ছেন। অথচ ভাবতেই অবাক লাগে এই পরিমান টাকা আয় করতে ওদের অন্তত দুই তিনদিন পরিশ্রম করতে হয়। রাজনীতির নামে ধর্মীয় ভন্ডামি না করে এই সমস্ত বিষয় নিয়ে ভাবলে ভালো হয় না কি?

বেঙ্গালোর থেকে ফেরার ট্রেনেও সেই একই দৃশ্য। যাদের কনফার্ম টিকিট তারাও এই কষ্ট ভোগ করে। টিকিট বাবুরা তো টাকা নিয়ে সবাইকেই স্লিপার কামরায় ঢুকিয়ে দেয়, কিন্তু এত মানুষ যে কোথায় বসবে, কোথায় ঘুমাবে কেউ ভাবে না। ভাবতে হয় স্লিপার কোচের যাত্রীদেরই, যাদের টিকিট কনফার্ম থাকে। যাশবন্তপুর থেকেই ট্রেন ভর্তি হয়ে গেলো। জেনেরাল কামরার কথা ছেড়েই দিলাম, রেল কোম্পানি তো ধরেই নেয় ওতে গরু ছাগল ওঠে। AC তে AC বাবুরা ওঠেন, সেখানে waiting টিকিট এর allow নেই। তবে এর যাবে কোথায়? ঘুরে ফিরে সেই খাড়ার ঘা এসে পড়লো মধ্যবিত্তের উপরে। RAC টিকিট, waiting টিকিট, যারা ফাইন দিয়েছে এবং যাদের স্লিপার কনফার্ম টিকিট আছে সবাই যাবে স্লিপার কামরায়, এ যেন রাজার বিধান। একবার ভেবে দেখুন, যে কটা berth সেকজন মানুষ তো আছেই, উপরন্ত ফাইন দেওয়া মানুষ আর waiting মানুষ। আমি নিজে প্রায় সব কটি স্লিপার কামরা ঘুরে দেখলাম অবস্থা একই। প্রত্যেক berth এ তিনজন ভাগ করে নিচ্ছে। এখানে একজন সেই berth এর কনফার্ম টিকিট ধারী, আর বাকি দুজিন হয়তো waiting টিকিট বা জেনেরাল টিকিটের উপরে ফাইন দিয়েছে। এবার আসি যারা মেঝেতে বসে এবং সেখানেই রাতে ঘুমিয়ে পড়েন। এমন অনেক কামরা দেখলাম যেখানে মানুষ টয়লেটে দাঁড়িয়ে আছে দু রাত একদিন। ট্রেনে খাবার নেই, station এ পানিয় জল নেই, টয়লেটে জল ছেড়েই দিলাম। তার উপরে ট্রেন চলে কম করে ১ ঘন্টা দেরিতে। একটু ভেবে দেখুন, sleeper কামরায় সকলেই কিন্তু sleeper এর ভাড়া দিয়েছে অথবা তারও বেশি, কিন্তু সেই টাকার বিনিময়ে পরিষেবা কি পেয়েছে? আমার প্রশ্ন একটাই, adjust শুধু মধ্যবিত্ত করবে কেন? পয়সা তো আমরা কম দেয়নি?

ট্রেনে বিরিয়ানি নামক যে খাবার বিক্রি হয়, সেটি যে কি বস্তু আজও বুঝলাম না। খিদের জ্বালায় নিরুপায় হয়ে সেটাই কিনে খেতে হয়। সেদ্ধ চাল, একটু হলুদ রং মেশানো আর সঙ্গে একটু সেদ্ধ গাজরের টুকরো, এটাই ভেজে বিরিয়ানি। এই সেদ্ধ বিরিয়ানিতে যদি দুটি পায়রার ডিম সেদ্ধ ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তবে সেটি egg বিরিয়ানি। ভেজ বিরিয়ানি ৮০ টাকা, egg বিরিয়ানি ১০০ টাকা, কত খাবি খা। ১ লিটার জলের বোতল ২০ থেকে ২৫ টাকা। প্রায় সব স্টেশনে ঘটা করে জলের ATM বসিয়েছে, কিন্তু ১০০ এর মধ্যে ৮০টি বন্ধ। ট্রেনের চা নামক যে পেনিয় বিক্রি হয় সেটির গোপন রেসিপি কেউ জানে না। যে দেশের রাজা এক সময় ট্রেনের কামরায় চা বিক্রি করেছেন, তার কাছে তো এখন একটু ভালো চা আশা করা যেতেই পারে। যেখানে বিদেশি কোম্পানি google ফ্রীতে প্রায় সব স্টেশনে ইন্টারনেট পরিষেবা দিচ্ছে, সেখানে আমাদের সরকার একটু খাবার আর পানীয় জলের পরিষেবা দিতে ব্যর্থ। জল আর খাবার আমার ফ্রীতে চাই না, নায্য পয়সা দিয়েই কিনবো।

শুনেছি বিমানে ভ্রমণের সময় কিছু অসুবিধা হলে বা ঝামেলা হলে অনেক রকম ছাড় দেওয়া হয় ভ্রমনকরি কে। ট্রেনে যারা AC তে ভ্রমণ করে তাদেরও খেয়াল রাখা হয় বাবুর মত। শুধু sleeper কামরা / sleeper coach এর যাত্রী তাহলে এত adjust করবে কেন? আমারও তো মানুষ? আমরাও তো নায্য টাকা দিয়েছি টিকিটের! তবে কেন আমরা এতটা গুরুত্বহীন, তাহলে কি আমাদের ঘরে ফেরা অপ্রাসঙ্গিক ধরে নেবো!

★ আমার লেখায় অজস্র বানান ভুল থেকে যায়, পাঠকের চোখে পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন ★

সঞ্জয় হুমানিয়া – বারাসাত
১৫ জুন ২০১৮


Share this post:
Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *