ধরুন, একটা অচেনা নম্বর থেকে আপনার হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেঞ্জারে কিছু একটা বার্তা অর্থাৎ ম্যাসেজ এলো, এই ধরুন হায় বা হ্যালো। ওমনি আপনার কৌতূহলী মন অবশ্যই সেই বার্তাটির উত্তর দিয়ে জিজ্ঞাসা করবে যে, কে এই অচেনা নম্বরের মালিক। হয়তো সে আপনার পরিচিত কেউ হতে পারে, বা কেউ অপরিচিতও হতে পারে। অথবা ট্রু কলারে টুক করে আপনি দেখে নেবেন নম্বরটি কার। তার পরে চ্যাট কররা ইচ্ছা বা প্রয়োজন হলে করবেন বা আপনিও হায় হ্যালো করে রেখে দেবেন। মোট কথা রিপ্লাই আপনি দেবেনই। এবার হয়তো অনেকেই বলেবেন, “আমি দেই না”। এই ছোট ব্যাপারটা বলার পিছনে আমার উদ্দেশ্য এই যে, আমারা সকলেই কৌতূহলী। অজানা কে জানার ইচ্ছা মোটামুটি সকলের মধ্যেই থাকে, শুধু মাত্র কিছু মানুষ ছাড়া।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আমাদের অনেকেরই প্রথম কাজ নিজের স্মার্ট ফোনটি হাতে নিয়ে প্রথমে হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেঞ্জারে তার পর ফেসবুক এবং শেষে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে উকি মারা। আমাদের এই উকি মারার পিছনে কি উদ্দেশ্য? এখানেও সেই কৌতূহলী মনই দায়ী। আমারা সকালে ঘুম থেকে উঠেই কিছু একটা নতুন আশা করি, এই ধরুন নতুন কোন চমক। আগেকার দিনে এই নতুন চমক হয়তো থাকতো জলখাবারের টেবিলে, বা খাবরের কাগজে। সময় পাল্টাচ্ছে, জলখাবার বা খাবরের কাগজ বা এফ এম রেডিও এখন অতীত, এখন সকালে উঠেই আমরা নতুন কিছু খুজি আমাদের স্মার্ট ফোনে। আমারা ঘুম থেকে উঠেই কম করে ৫ মিনিট আর সর্বাধিক ১ ঘণ্টা ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করি, এটাই স্বাভাবিক আজকাল।
কিন্তু এক ধরণের মানুষ আছে, যারা এই সব মানে না। তারা অতি সম্মানীয় ও ভদ্র, সাধারণ মানুষ যে সব কাজ কর্ম করে, এরা সে সব করে না, বলতে গেলে ইচ্ছা করেই করে না। এই ভয়ে করে না বা লোক দেখানোর জন্য করে না, পাছে জনগণ তাদের সাধারণ মানুষ ভেবে ফেলে। এক কথায় বলতে গেলে তারা নিজেদের কে মনে মনে অসাধারণ কিছু মানুষ মনে করে বা ভাবতে শুরু করেছে। এবার প্রশ্ন হোল, কারা এরা? সমাজের প্রতি স্তরে আছে এরা। এরা পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানেও থাকে, আবার পুকুর ঘাটে জামরুল গাছ তলায়ও থাকে। ভিড় ট্রেনেও থেকে, আবার আবছা নীল আলোর রেস্তোরায়ও থাকে। এদেরকে দেখে চেনা যাবে না, দেখতে আমার আপনার মতই সাধারণ দেখতে, তবে এদের ভাবনা চিন্তা একটু বেঁকা।
এমনই কিছু মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। এই পরিচয় কে ঠিক পরিচয়ও বলা যায় না। পরিচয় কাকে বলে? সহজ করে বলতে গেলে একটা উদাহরণ প্রয়োজন। যেমন, ধরুন আপনি বাসে উঠেছেন, কোন এক নতুন যায়গায় যাচ্ছেন, আগে কোন দিন সেখানে যাননি। আপনি অবশ্যই আপনার পাশে বসে থাকা মানুষটি কে জিজ্ঞাসা করবেন, “দাদা, হাওড়া ইস্টিশন যেতে কত সময় লাগবে?” উত্তরে লোকটি কিছু একটা বলেবে। তার পর যাত্রা পথে কথাবাত্রা বলতে বলতে একে অপরের সম্বন্ধে তথ্য আদান প্রদান করলেন। এটাকে আপনি পরিচয় বলতে পারেন। আবার এটাও হতে পারে, আপনি প্রশ্ন করলেন, কিন্তু উত্তর পেলেন না। আপনি আবার অন্যজন কে একই প্রশ্ন করলেন, তিনি হয়তো উত্তর দিলেন, এবং কিছুখন পরে যখন এই দ্বিতীয় লোকটির পাশের সিট খালি হোল, আপনি টুক করে সেই সিটে উঠে গিয়ে চুটিয়ে আড্ডা দিতে দিতে হাওড়া পৌঁছেগেলেন। দ্বিতীয় উদাহরণের প্রথম লোকটির সাথে এই সাক্ষাৎ কে কিন্তু পরিচয় বলা যায় না। কারন দুজনের একজন তথ্য আদান প্রদানের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু দ্বিতীয় জন সেই আমন্ত্রণে সাড়া দেয়নি। সাড়া দিয়েছিল এবং পরিচয় হয়েছিলো পাশের অন্য সিটে বসে থাকা অন্য জনের সাথে।
আমার ছোট বোনের বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে। বিভিন্ন উপায়ে আমার পাত্র খুচ্ছি। এই ধরুন কিছু ঘটক পুষেছি, আত্মীয়দের বলে রেখেছি, পরিচিত বন্ধু বান্ধবদের বলে রেখেছি, আর নিয়মিত প্রতি রবিবার দুটি বা তিনটি খাবরের কাগজের পাত্রপাত্রী বিজ্ঞাপন অনুস্মরণ করছি। এই কাজের প্রধান কর্তা আমার বাবা, এবং সহকারী হিসাবে আমি আর আমার দিদি। প্রত্যেক রবিবার সকাল সকাল বাবা খাবরের কাগজ, সাদা কাগজ, কলম আর ফোন নিয়ে বসে পড়েন। প্রথমে সব কটি কাগজ থেকে সুন্নি মুসলিম পাত্রদের বিজ্ঞাপনে লাল কালির কলম দিয়ে গোল গোল দাগ দেয়। তার পর সেই সব বাছাই করে সাদা কাগজে টুকে রাখে। তার পরে একে একে সকল কে ফোন করে। বাবা প্রথমেই নিজের পরিচয় দিয়ে কাজের কথায় যায়। কিন্তু আজ কাল সকলের উত্তর ওই একটাই, “কাগজে বিজ্ঞাপনে তো সব কিছু দেওয়া আছে, আপনি আপনার মেয়ের বায়োডাটা আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ছবি সহ পাঠিয়ে দিন” বলেই টুপ করে অভদ্রের মত ফোন কেটে দেয়। এবার আপনিই বলুন, পাত্র পাত্রী বিজ্ঞাপন কেমন হয়? যত কম সম্ভব অক্ষর বা শব্দ ব্যাবহার করে মনের ভাব কে প্রকাশ করাকেই পাত্র পাত্রী বিজ্ঞাপন বলে। মানলাম এই খাবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য তাদের কে অনেক ফোন ধরতে হয়। তাই বলে এতে বিরক্ত হওয়ার কি আছে? পাত্রের বিজ্ঞাপন দিলে তো ফোন অবশ্যই আসবে! ফোন আসার জন্যই তো বিজ্ঞাপন দেওয়া, এখানে এত বিরক্ত হওয়ার কি আছে?
এখানে বলে রাখি, এই যে বা যারা তোতাপাখির মত বুলি আওড়ে ছবি আর বায়োডাটা চেয়েই ফোন কেটে দেয়, এনারা আসলে বিরক্ত বা খুব ব্যস্ত নন, এনারা তাদের ব্যাবহার দিয়ে বোঝাতে চাইছেন যে তারা পাত্র পক্ষ আর আমার অতি অসহায় পাত্রী পক্ষ।

এবার আসছি দ্বিতীয় পর্বে। বাবা, সবাইকে ফোন করে এবার দিদি কে বা আমাকে ফোন করে বলবে এই সব নম্বরে ছোট বোনের ছবি আর বায়োডাটা পাঠাতে হবে। কারন বাবা স্মার্ট ফোন ব্যাবহার করেন না। আমি তখন একে একে আমার নিজের হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ছোট বোনের ছবি ও বায়োডাটা পাঠাতে শুরু করি। প্রথম দিকে আমি নিজের পরিচয় দিয়ে, তাদের সম্মতি চাইতাম ছবি আর বায়োডাটা পাঠাবার। কিন্তু ১০ জনের মধ্যে মাত্র ১ বা ২ জন উত্তর দিতেন আর বাকি সবাই চুপচাপ। আপনারা ভাবছেন হয়তো তারা অন্য কাজে ব্যস্ত সেই সময় তাই তখন উত্তর দেয়নি, বা আমার বার্তা হোয়াটসঅ্যাপ খুলে দেখেনি তাই হয়তো উত্তর দেয়নি। এবার বলি, আপনাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। প্রত্যেক জন আমার হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা দেখেছেন ও পড়েছেন। কারন রবিবার সকালে উঠে তাদেও ওই কাজ, বার্তা দেখা। প্রত্যেকটি বার্তা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই Seen এবং হোয়াটসঅ্যাপের দুটি ঠিক চিহ্ন নীল রঙ্গে পরিবর্তন হয়। এর মানে আমি কি বুঝবো? তারা সব দেখছে কিন্তু ন্যূনতম একটা উত্তর দিতে তাদের আঙ্গুল ব্যথায় আর ক্লান্তিতি উত্তর লিখতে অক্ষম? না, কারন সেটা না। তারা ইচ্ছা বা অনিচ্ছা করেই এটা বোঝাচ্ছে যে তারা পাত্র পক্ষ, আমরা পাত্রী পক্ষ, এবং আমাদের পাত্রী ডানাকাটা পরী না আর তাদের রাজপুত্রের মনে দাগ কাটতে পারেনি। আজকাল ফেসবুকে বা হোয়াটসঅ্যাপে অনেক অলস দেখেছি, যারা OK কে K লেখে, good night কে gudN8 লেখে বা আরো অন্য শর্টকাট, কিন্তু এই পাত্র বিজ্ঞাপনের আড়ালে থাকা মানুষগুলো সবার উপরে। ১০০ জনের মধ্যে ৪ থেকে ৫ জনের কাছ থেকে আমি উত্তর পেয়েছি, তারা সরাসরি জানিয়ে দেয়, হয় তাদের অন্য পাত্রী পছন্দ হয়েছে বা আমাদের পাত্রী তাদের চাহিদা মত না, কিম্বা কিছু একটা উত্তর। আমি কিন্তু এই সরাসরি উত্তরের আশায় থাকি।
সব থেকে বিরক্ত লাগে তখন, যখন আমার ফোনের হোয়াটসঅ্যাপের নিচের দিকের সব seen বার্তা গুল দেখি আর দেখি কোন উত্তর নেই, কিন্তু সব seen আর last activity ৩ মিনিট আগে।
কিছু মানুষ আমাদের আশেপাশেই আছে, যারা নিজেদের কে সাধারণ মানুষ ভাবতে ভয় পায়। তাদের জীবনযাপন কিন্তু অতি সাধারণ, সকাল বেলা ঢোলা পায়জামা পরে কাপড়ের তৈরি ছোট থলে নিয়ে এরাও বাজারে গিয়ে ২৫০ গ্রাম কুমড়ো আর ২০০ গ্রাম আলু কেনে। কিন্তু পাছে অন্যরা আর পাঁচজনের মত তাদের সাধারণ দেখতে লাগে, তাই তারা সব সময় চেষ্টা করে একটু আলাদা, একটু অসাধারণ হিসাবে নিজেদের প্রমান করতে।
আমি যখন ইস্কুলে পড়তাম, তখন আমাদের ইস্কুলে আশক কাকু বলে একজন কর্মী কাজ করতেন। ওনার মুখে প্রাই শুনতাম, “যাদের এক কান কাটা, তারা গ্রামের এক পাশ দিয়ে যায়। আর যাদের দুই কান কাটা তারা গ্রামের মাঝখান দিয়ে যায়, জাতে সবাই তাদের লক্ষ করে”
যাদের এক কান কাটা, তারা লজ্জায় গ্রামের লোক চক্ষু এড়িয়ে গ্রামের পাশের রাস্তা দিয়ে যায়। আর যাদের দুই কানই কাটা, তারা নিজেদেরকে একটু আলাদা দেখাবার জন্য গ্রামের মধ্য দিয়ে যায়। তাদের তো দুই কান কাটা পড়েছে, লোকে তো পাত্তা দেয় না, তাই সবার সামনে সং সেজে রং দেখায়। খাবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেওয়া পাত্রদেরও সেই একই অবস্থা। সব যায়গায় ডানা কাটা পরী খুঁজে খুঁজে যখন ক্লান্ত, তখন নিজের বিজ্ঞাপন দিয়ে পাত্রী খুচ্ছেন।
আমার লেখা পড়ে হয়তো অনেকেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবেন। তাদের আমার বয়েই গেলো।
সঞ্জয় হুমানিয়া
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বেঙ্গালুরু, ইন্ডিয়া