Share

ছিপ বড়শির গল্প

ছোটবেলায় আমাদের পালের গোদা ছিল হাপি ভাই। শবেবরাতের সন্ধ্যায় টিনের কৌটো আর মোমবাতি দিয়ে লাইট বানানো, বুড়ির ঘর পোড়ানোর সময় বুড়ির ঘর বানানো, পাটকাঠির মশাল বানানো, ঝিনুক ঘষে আমের খোসা ছাড়ানোর যন্ত্র বানানো, বাসের পিচকারী বানানো ও মাছ ধরার ছিপ বানানো, প্রায় সব কিছুর হাতে খড়ি এই হাপি ভাই এর কাছে। হাপি ভাইয়ের ভালো নাম হাফিজুল মন্ডল। সম্পর্কে আমার পাড়াতুতো দাদা বা ভাই। বয়সের আমাদের থেকে অনেক বড়ো, তবুও হাপি ভাইয়ের এইসব সামাজিক কাজে আমরা সঙ্গ পেয়েছি।

একবার পাড়ায় ছিপ দিয়ে মাছ ধরার ধুম পড়ে গেলো। হাপি ভাই দুটি ছিপ বানিয়ে দিয়েছিল আমাদের। বাশেঁর শক্ত ও দৃঢ় কঞ্চি বা কাঠিতে সূতা বেঁধে জলে ছেড়ে দেয়া হয়। সূতার অন্য প্রান্তে থাকে লোহার তৈরী বড়শী। বড়শীতে টোপ লাগিয়ে ছিপ ফেলা হয়। মাছ টোপ গিললে সূতায় টান পড়ে এবং তখন ছিপ দ্রুত টেনে তোলা হয়। সূতার মাঝামাঝি থাকে ফাৎনা যা জলেতে ভেসে থাকে। টোপে মাছ ঠোকর দিলে ফাৎনা নড়ে ওঠে। টোপ-গেলা মাছ নড়াচড়া শুরু করলে ফাৎনা নড়তে থাকতে। তাতে বোঝা যায় মাছ টোপ গিলেছে। তখন ছিপ দ্রুত তুলে নিতে হয়। একদিন দুপুর বেলা খাওয়াদাওয়ার পরে বাড়ির খিড়কি দরজা চুপিসারে খুলে পশ্চিম দিকে পুকুর ধারে জামরুল তলায় দাড়িয়ে পুকুরে ঢিল ছুড়ছিলাম।

পুকুরের পাড় ঘেঁষে পায়ে হাঁটার পথ চলে গিয়েছে পুকুরের অপর প্রান্তের বাশবাগানে। এই পথে ধরেই হাপি ভাইকে বাশবাগান থেকে ফিরতে দেখলাম। হাতে লম্বা দুটি কঞ্চি, মুখে মিটিমিটি হাসি। আমার কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় ফিসফিস করে বলে গেলো, “সঞ্জয়, আয় ছিপ বানানো দেখে যা”। পিছন পিছন আমি আমাদের বাড়ির পিছনে চললাম। আমাদের বাড়ির পিছনে হাপি ভাইদের বাড়ি, আর তার পিছনে একটু ফাঁকা জায়গা। দুটি বাড়ির পূব দিক থেকে গ্রামের মেঠো রাস্তা। দা দিয়ে বেশ সৌখিন ভাবে কঞ্চি কেটে চেঁছে ফেলা হল। ছিপটা বেশ লম্বা, ৫ ৬ হাত লম্বা প্রায়। ছিপ বানাতে বানাতে হাপি ভাইয়ের মুখে হুইলের গল্প শুনেছিলাম। বড়োলোকেরা নাকি দোকান থেকে কেনা ছিপে মাছ ধরে, আর তাকে নাকি হুইল বলে। হুইলে নাকি অনেক লম্বা সুতো থাকে। ঘুড়ির লাটাইয়ের মত কি একটা ছিপের হ্যান্ডেলে লাগানো থাকে। হুইল নিয়ে নানা আজব গল্প করতে করতে হাপি ভাই নিজের সখের ছিপ তৈরি করছিলো। ছিপ প্রায় চাঁছা ছেলা শেষ। এবার সুতো ফাতনা আর বড়শী লাগালেই তৈরি।

আমি সেখানেই দাড়িয়ে, হাপি ভাই এক দৌড়ে ওদের ঘরে গিয়ে একটা মর্চে পড়া সালিমার নারকোল তেলের ছোট কৌটো নিয়ে এলো। কৌটোর ভিতরে অগোছালো ভাবে ছিপের সুতো রাখা আছে। মাপ করে সুতো কেটে নেওয়া হল, ফাতনা কাটা হল। কৌটোর নিচে বড়শী থাকার কথা, কিন্তু খুঁজে পাওয়া গেলো না। কৌটো উপুড় করে ফেলেও বড়শী পাওয়া গেলো না। হাপি ভাই কে বেশ উত্তেজিত লাগছিলো। শেষমেশ অনেক খুঁজেও পাওয়া গেলো না বড়শী। হাসিহাসি মুখ নিয়ে আমার দিকে হাপি ভাই তাকিয়ে বলল, “সঞ্জয়, তুই একটু দৌড়ে জামরুলের দোকান থেকে একটা বড়শী কিনে আন”। আমি তো যাবো না বলে মাথা নাড়তে শুরু করেছিলাম। হাপি ভাইও নাছোড়বান্দা, আমাকেই পাঠাবে। অবশেষে আমাকে লজেন্স কিনে খাওয়ার লোভ দেখাল। তাতেও আমি অনড়।

শেষমেশ হাপি ভাইয়ের করুণ মুখ দেখে আমার মায়া হলো, আমি রাজী হয়ে গেলাম। আমার হাতে ১ টাকার একটি কয়েন দিয়ে বললে, দৌড়ে যা। আমি এক ছুটে রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেলাম। বড়শী কিনলাম, কিন্তু লজেন্স কিনলাম না। ফেরার পথে ভাবতে ভাবতে আসছি, হাপি ভাইকে ৫০ পয়সা ফেরৎ দিলে খুব খুশি হবে। আমাদের জন্য কত কি বানিয়ে দেয়, আর আমি একটা বড়শী কিনে এনে দিতে পারবো না? নিশ্চয়ই পারবো। এই সব ভাবতে ভাবতে ৫০ পয়সা হাতের তালুতে নাচাতে নাচাতে ফিরছি। হথাৎ হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লাম রাস্তার উপরে। হাত থেকে ছিটকে কথায় হারিয়ে গেলো ৫০ পয়সা । আমি তাড়াতাড়ি উঠে জামা প্যান্ট ঝেড়ে পাগলের মত পয়সা খুঁজতে লাগলাম। কিছুতেই পেলাম না, কি হবে এবার?

পকেট থেকে বড়শী নিয়ে হাপি ভাইয়ের হাতে দিয়েছিলাম। হাপি ভাই জিজ্ঞাসা করেছিল, “লজেন্স খেয়েছিস?”। আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছিলাম, মুখ খুলিনি। ফাঁকা মুখের ভেতর জিভ এমন ভাবে ঘোরাতে লাগলাম যাতে মনে হয় আমার মুখে লজেন্স আছে, এখনো চুষছি। লজেন্স তো সত্যি ছিল না, ওটা সত্যি নয়!! অভিনয়।