Share this post:

বয়স ৫০ বা ৫৫, বেঙ্গালুরুর রূপেন-আগ্রাহারাহার ভিরাট নগর এলাকায় রাস্তার ধারেই ঠেলা গাড়িতে ফুল বিক্রি করে একজন প্রবীণ। এখানে বিকাল থেকেই এমন অনেক ফুলওয়ালা আপনি দেখতে পাবেন রাস্তায় রাস্তায়, পূজার ফুল বিক্রি করে বেড়াচ্ছে। এই প্রবীণ অবশ্য ফেরিএয়ালা নয়, রাস্তার নির্দিষ্ট এক যায়গায় গত ২০/২২ বছর ধরে ঠ্যালা গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফুল বিক্রি করেন প্রতি সন্ধ্যায়। মাথায় সাদা টুপি, চোখে সুর্মা, কপালের মাঝখানে কালো দাগ। দীর্ঘ দিন দিনে ৫ বার নামাজ পড়লে এমন কালো দাগ পড়ে যায় অনেকের।

ব্যাপারটা ভালো করে দেখার জন্য একদিন দিনের আলো থাকতে থাকতেই পৌঁছে গেলাম। প্রবীণ তখন দোকান সাজাতেই ব্যস্ত। রাস্তার অন্য প্রান্থে আমি ঘুরঘুর করতে শুরু করলাম। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মত এখানকার চায়ের দোকানে কেউ এক কাপ চা খেয়ে গোটা সন্ধ্যা কাটিয়ে দেয় না। চায়ের দোকান আছে, বসার যায়গাও আছে, তবে কেউ দল বেঁধে বসে PNPC করে না। আমি কিছুক্ষণ চায়ের দোকানে বসছি আবার কখনো খুবিই ব্যস্ততার ভান করে কারো জন্য অপেক্ষা করার অভিনয় করে চলেছি।

সন্ধার অন্ধকার গাঁড়ো হয়ে এসেছে, লোকজনের চলাচল বেড়েছে, ফুলের দোকানে বেচাকেনা শুরু হয়েছে। প্রবীণ মুসলিম পূজার ফুলের দোকানদার হাসি মুখে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলছে আর বেচাকেনা করছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সকল ক্রেতাই তার পরিচিত। পূজার ফুল হল দুধের মত, দুধ যেমন সকাল হলেই প্রতিদিন প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমন প্রতি সন্ধ্যায় পূজার ফুলের প্রয়োজন হয়। সকলেই যারা ফুল কিনতে আসছে, প্রথমেই দোকানদারের সাথে কথা বলছে হাসি মুখে, তার পরে ফুল কিনে চলে যাচ্ছে। কথা শুনতে না পেলেও বোঝা যাচ্ছে, একে অপরের কুশল মঙ্গল জিজ্ঞাসা করে ফুল কেনা বেচা চলছে।

আমার এই প্রবীণ পূজার ফুল বিক্রেতার সাথে আলাপ করতে ইচ্ছা হলো। এমনি তো আলাপ করা যায় না, কাজেই ফুল কিনতে হবে। ধিরস্থির ভাবে এগিয়ে গেলাম দোকানের দিকে। দেখলাম ফুলের দোকানে গোলাপ ফুল নেই। আমি জিজ্ঞাসা করলাম হলুদ রঙের গোলাপ ফুল আছে কি। উত্তরে প্রবীণ ফুল বিক্রেতা উর্দু আর হিন্দি মিশিয়ে বললেন, হলুদ গোলাপ চলে না তাই রাখে না, যদি প্রয়োজন থাকে তো বললে আগামী কাল এনে দেবেন। তিনি রোজ দোকান খোলেন কি না জিজ্ঞাসা করায়, উত্তরে বললেন যে প্রায় ২০/২২ বছর তিনি প্রতিদিন দোকান খুলছেন, কোন দিন নিজের ইচ্ছায় বন্ধ রাখেনি। দোকান রোজ খোলা থাকে সন্ধ্যায়। লোকটি খুবি মিষ্টি ভাষী।

রাতে ঘরে ফিরে এসে মাথার মধ্যে অনেক কথা ঘোরাফেরা করতে লাগলো। যেমন, সকলে পূজার ফুল নির্দ্বিধায় এই ২০/২২ বছর ধরে কিনে যাচ্ছে একটা মুসলিম ফুল বিক্রেতার কাছ থেকে। ক্রেতা বা বিক্রেতা কারো কোন সমস্যা নেই। নিশ্চয়ই বেচাকেনা ভালো হয়, ওই জন্য গত ২০/২২ বছর ধরে সে এই একই কাজ করছে। যারা ক্রেতা, সকলেই পরিচিত, তবুও কোন সমস্যা নেই এই মুসলিম পূজার ফুল বিক্রেতাকে নিয়ে। আমার মনে হয় এমন দৃশ্য হয়তো সারা ভারতে অনেক যায়গায় দেখা যাবে। এটাই হল মানবিকতা। আমারা যদি মন থেকে পরিষ্কার থাকি, তবে মনে হয় বাইরের এই জাতপাত ভেদাভেদ অর্থহীন। খুশীতে মনটা ভরে উঠলো।

Sanjay Humania
February 12, 2019 – Bangalore

Share this post:
Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *